Saturday, 6 December 2025

Caste System of Hinduism: Critical Review (হিন্দু ধর্মের বর্ণ প্রথা: শাস্ত্র, সমাজ এবং সমালোচনামূলক পর্যালোচনা)


 

হিন্দু ধর্মের বর্ণ প্রথা: শাস্ত্র, সমাজ এবং সমালোচনামূলক পর্যালোচনা

ধর্মের বর্ণ প্রথা: শাস্ত্র, বিবর্তন ও সংস্কার

​১.০। মুখবন্ধ: বর্ণ প্রথা ও জাতিরূপ মিথের বিশ্লেষণ

​হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভাজনের যে প্রচলিত প্রথা বিদ্যমান, তা প্রায়শই ধর্মীয় পবিত্রতা, কঠোর সামাজিক গতিহীনতা এবং জন্মভিত্তিক বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই শ্রেণিবিন্যাস ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত বিষয়, যেখানে দার্শনিক আদর্শ ও কঠোর সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এই প্রতিবেদন বর্ণ প্রথার উৎস, এর শাস্ত্রীয় ভিত্তি, ঐতিহাসিক বিবর্তন, এবং যুগে যুগে বিভিন্ন ভাষ্যকার ও সংস্কারকদের মতামতের একটি গভীর বিশ্লেষণ প্রদান করে।

​১.১। গবেষণাটির উদ্দেশ্য, পরিপ্রেক্ষিত ও কাঠামোগত ভূমিকা

​এই প্রতিবেদনের প্রধান লক্ষ্য হলো বর্ণ প্রথাকে কেবল একটি ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা হিসেবে না দেখে, বরং সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা। বিশেষত, তাত্ত্বিক ‘বর্ণ’ (Varna) ব্যবস্থা কীভাবে জন্মভিত্তিক ‘জাতি’ (Jati/Caste) প্রথার কঠোর রূপ ধারণ করল, সেই ঐতিহাসিক ফাটলটি চিহ্নিত করা এই গবেষণার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। প্রচলিত সামাজিক মিথ (myth) থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়গুলিও এখানে আলোচনা করা হবে, যা এই প্রথাকে এক ভয়াবহ সামাজিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

​১.২। শব্দার্থগত বিভাজন: ‘বর্ণ’ বনাম ‘জাতি’ (Varna vs. Jati/Caste)

​সমাজতত্ত্ব ও ধর্মীয় পাঠের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বর্ণ’ এবং ‘জাতি’র মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য না বোঝার ফলেই সমাজে এক ভয়াবহ ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে।

​১.২.১। বর্ণ (Varna)

​বর্ণ বলতে তাত্ত্বিকভাবে চারটি শ্রেণিতে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) বিভাজনকে বোঝায়। শাস্ত্রীয় গ্রন্থ, বিশেষত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা , অনুসারে এই শ্রেণিবিন্যাস গুণ (Guna) এবং কর্মের (Karma) ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণরা জ্ঞান ও শিক্ষাচর্চার মাধ্যমে, ক্ষত্রিয়রা শাসন ও রক্ষার মাধ্যমে, বৈশ্যরা ব্যবসা ও উৎপাদনের মাধ্যমে এবং শূদ্ররা সেবাকর্মের মাধ্যমে সমাজের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার জন্য নির্ধারিত ছিল । শাস্ত্রীয়ভাবে এই ব্যবস্থায় নমনীয়তা এবং ব্যক্তির যোগ্যতা অনুযায়ী স্থান পরিবর্তনের সুযোগ থাকা উচিত ছিল।

​১.২.২। জাতি (Jati/Caste)

​অন্যদিকে, জাতি হলো বাস্তব সামাজিক একক, যা জন্মভিত্তিক, বংশানুক্রমিক এবং অঞ্চল ও পেশাভেদে হাজার হাজার উপ-জাতিতে বিভক্ত । জাতি প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বংশানুক্রমিকতা, যেখানে একজন ব্যক্তি যে জাতিতে জন্মগ্রহণ করে, তাকে আজীবন সেই পরিচয়েই বহন করতে হয় । এছাড়াও এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো অন্তর্বিবাহ গোষ্ঠী (Endogamy), নির্দিষ্ট পেশা, এবং পবিত্রতা-অপবিত্রতা (Purity and Pollution) সংক্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে এক জটিল ক্রমোচ্চ শ্রেণী বিন্যাস ।

​ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, যদিও ধ্রুপদী হিন্দু সাহিত্যে বর্ণ (Varna) প্রথার কথা প্রায়শই উল্লিখিত হয়েছে, সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের মতে আধুনিক সময়ে জাতি (Jati) প্রথাই সামাজিক ভূমিকা পালন করে । এই জাতি প্রথার অস্তিত্বের প্রমাণ তুলনামূলকভাবে দেরিতে পাওয়া যায় । সমাজ যখন একটি নমনীয়, গুণ-কর্মভিত্তিক আদর্শ (Varna) থেকে একটি কঠোর, জন্মভিত্তিক কাঠামোর (Jati) দিকে সরে যায়, তখন এই বৈষম্যকে বৈধতা দেওয়ার জন্য একটি তাত্ত্বিক ছদ্মবেশ হিসেবে ওই আদর্শের অপব্যাখ্যা শুরু হয়। ফলে এই বিভাজনকে ঐশ্বরিক বা প্রাকৃতিক বলে মনে করার ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়।

​২.০। বর্ণ প্রথার মূল শাস্ত্রীয় উৎস অনুসন্ধান: ঋগ্বেদ ও গীতা

​বর্ণ প্রথার উৎসের সন্ধান করতে গেলে প্রাচীনতম শাস্ত্র, বেদ এবং পরবর্তীকালে জনপ্রিয় ধর্মগ্রন্থ গীতার দিকে দৃষ্টি দিতে হয়।

​২.১। ঋগ্বেদীয় উৎস: পুরুষ সূক্ত (RV 10.90.12) ও প্রক্ষেপণ বিতর্ক

​বর্ণ প্রথার ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক যৌক্তিকতার ভিত্তি হিসেবে সাধারণত ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সূক্তের (১০.৯০.১২) উল্লেখ করা হয় । এই মন্ত্রে বিরাট পুরুষের যজ্ঞ থেকে সমাজের চারটি শ্রেণির উদ্ভব দেখানো হয়েছে: মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি । প্রতীকীভাবে এটি একটি শ্রমবিভাগের ধারণা দেয়।

​তবে, এই সূক্তের মৌলিকতা নিয়ে পণ্ডিত সমাজে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। অনেক পণ্ডিত মনে করেন পুরুষ সূক্ত ঋগ্বেদের তুলনামূলকভাবে পরবর্তী সংযোজন বা প্রক্ষেপণ (Interpolation)। এর প্রধান যুক্তিগুলি হলো:

​১. ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক প্রমাণ: ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন সূক্তটির ভাষা ও ব্যাকরণ ঋগ্বেদের অন্যান্য অংশের তুলনায় উন্নত বা অপেক্ষাকৃত আধুনিক ।

২. একমাত্র উল্লেখ: এটি ঋগ্বেদের একমাত্র স্তোত্র যেখানে চারটি বর্ণের (Varna) স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ।

৩. সামাজিক কারণ: স্টেফানি জেমিসন এবং জোয়েল ব্রেটটনসহ অন্যান্য পণ্ডিতরা মন্তব্য করেছেন যে ঋগ্বেদে একটি বিস্তারিত, বহু-বিভক্ত বর্ণ ব্যবস্থার কোনো প্রমাণ নেই। তাঁরা মনে করেন যে ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসাম্যকে ধর্মীয় অনুমোদন দিতেই এই স্তোত্র পরবর্তীকালে যুক্ত করা হয়েছিল । ভারতীয় ঐতিহাসিক সুভিরা জয়সওয়াল এবং ড. বি. আর. আম্বেদকরও পুরুষ সূক্তকে ঋগ্বেদের প্রক্ষেপণ বলে মনে করতেন ।

​এই বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে প্রাচীনতম বৈদিক সমাজে বর্ণভিত্তিক কঠোর hierarchy সম্ভবত ছিল না। বর্ণ প্রথাকে আদি বা মৌলিক সত্য বলার দাবি এই প্রক্ষেপণ বিতর্কের মাধ্যমে দুর্বল হয়ে যায়।

​২.২। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দর্শন: গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি

​বর্ণ প্রথা নিয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়। শ্রীকৃষ্ণ চতুর্থ অধ্যায়ের ত্রয়োদশ শ্লোকে ঘোষণা করেন যে, "চাতুর্বর্ণ্য গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও" [৪.১৩]।

​গীতায় বর্ণের বিভাজন মানুষের স্বভাবজাত গুণানুসারে নির্ধারিত হয়েছে:

  • ব্রাহ্মণ: সত্ত্বগুণপ্রধান, যার কর্ম হলো শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা [১৮.৪১-৪২]।
  • ক্ষত্রিয়: সত্ত্ব-মিশ্রিত রজোগুণপ্রধান, যার কর্ম হলো পরাক্রম, তেজ, ধৈর্য, কার্যকুশলতা, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতা [১৮.৪৩]।

  • বৈশ্য: তমঃ-মিশ্রিত রজোগুণের আধিক্য, যার কর্ম হলো কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য [১৮.৪৪]।

  • শূদ্র: রজঃ-মিশ্রিত তমোগুণের আধিক্য, যার কর্ম হলো কেবল পরিচর্যাত্মক সেবা [১৮.৪৪]।

​আধুনিক ব্যাখ্যাকারীরা প্রায়শই উল্লেখ করেন যে, এই গুণ-কর্মভিত্তিক ব্যবস্থা একটি আদর্শ সামাজিক সংগঠনের রূপ, যার মূল বিকৃতি ঘটে তখনই, যখন এটি জন্মগত অধিকার দ্বারা নির্ধারিত হতে শুরু করে। জনপ্রিয় উক্তি অনুযায়ী, "birthright made the right wrong" ।

​তবে, দার্শনিক উদ্দেশ্য ছাড়াও গীতার একটি দ্বিমুখী সামাজিক ব্যবহার ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, গীতা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে রচিত হয়েছিল । এই সময়ে বৌদ্ধ, জৈন ও লোকায়ত দর্শন ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, কিছু বুদ্ধিমান মানুষ কৃষ্ণের উপদেশ ব্যবহার করে দার্শনিক মতবাদগুলিকে সমন্বিত করে এবং সেই সঙ্গে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রেণীগত মতাদর্শ জনগণের মানসিকতায় তুলে ধরার প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন । এই বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, যদিও গীতার মূল দর্শনে বর্ণ প্রথার পরিবর্তনশীলতার বীজ নিহিত ছিল, এর ঐতিহাসিক প্রয়োগ এবং রক্ষণশীল ব্যাখ্যাগুলি উচ্চ বর্ণের শ্রেণীগত আধিপত্য বজায় রাখার জন্য একটি শক্তিশালী কর্তৃত্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

​৩.০। বর্ণাশ্রম থেকে জাতিপ্রথার জন্ম: স্মৃতির বিধান ও সামাজিক ক্রমবিবর্তন

​বৈদিক যুগে নমনীয় ধারণা থাকার পরও, বর্ণ প্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি পায় স্মৃতি সাহিত্য, বিশেষত মনুসংহিতার মাধ্যমে।

​৩.১। মনুসংহিতা ও জন্মভিত্তিক আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা

​মনুসংহিতা (Manusmriti) গুণভিত্তিক আদর্শকে কঠোর জন্মভিত্তিক, স্থিতিশীল কাঠামোতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংহিতা ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বকে সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করে। মনুসংহিতায় স্পষ্টত বলা হয়েছে যে, একমাত্র ব্রাহ্মণই সকল বর্ণের শাস্ত্রসম্মত জীবিকার উপায় জানবেন এবং সকলকে উপদেশ দেবেন । ব্রাহ্মণগণকে ব্রহ্মার মুখ থেকে উদ্ভূত এবং বেদকে অবলম্বন করার কারণে এই সৃষ্ট জগতের প্রভু বলে ঘোষণা করা হয় । এমনকি রাজারও প্রতিদিন প্রত্যুষে বয়োবৃদ্ধ ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করা এবং তাদের আদেশ প্রতিপালন করা কর্তব্য বলে বিধান দেওয়া হয়েছে । এই বিধানগুলি ব্রাহ্মণদের আধিপত্যকে কেবল ধর্মীয়ভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবেও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল।

​মনুসংহিতার রক্ষণশীল ভাষ্যকারগণ, যেমন কুল্লুক ভট্ট, এই আধিপত্যকে আরও দৃঢ় করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, চারটি বর্ণের মধ্যে উপরের তিনটি বর্ণ 'দ্বিজাতি' (দুইবার জন্ম), কারণ কেবল তাদেরই উপনয়ন-সংস্কারের অধিকার আছে। শূদ্ররা 'একজাতি' (একবার জন্ম) হওয়ায় তাদের উপনয়নের অধিকার নেই, ফলে তারা নিম্নবর্ণীয় দাস হিসেবে গণ্য। একইভাবে কুল্লুক ভট্টের ব্যাখ্যানুসারে, নারীও দ্বিজ হবার অধিকার না পাওয়ায় শূদ্রসমতুল্য বা শূদ্রই । মনুসংহিতা শূদ্রদের একমাত্র কর্তব্য হিসেবে উচ্চ তিন বর্ণের সেবা নির্দিষ্ট করে এবং তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অংশগ্রহণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে ।

​এই বিচার দেখায় যে, মনুসংহিতার বিধান এবং কুল্লুক ভট্টের মতো ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যাগুলি ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক কর্তৃত্বকে আইনগত বৈধতা (Legalization of Brahmanical Hegemony) দেয়। এর ফলে গুণভিত্তিক Varna-এর নমনীয়তা বিলুপ্ত হয়ে জন্মভিত্তিক Jati-এর কঠোরতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।

​৩.২। জাতি প্রথার ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক বিবর্তন

​জাতি প্রথা (Jati system) বর্ণ প্রথার সেই কঠোরতার বিস্তারিত ও জটিল সামাজিক প্রকাশ। বর্ণ ব্যবস্থায় একটি মোটা দাগের শ্রমবিভাগ প্রতিভাত ছিল, কিন্তু জাতি প্রথায় সেই শ্রমবিভাগের ভিত্তিতেই হাজার হাজার উপ-জাতি তৈরি হয়, যা ছিল পেশাগত স্বাতন্ত্র্য এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি ।

​জাতি প্রথার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল:

​1.  বংশানুক্রমিকতা: জন্মই সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করত, গুণগত যোগ্যতা বা কর্মের দ্বারা জাতির পরিবর্তন সম্ভব ছিল না ।

2.  অন্তর্বিবাহ গোষ্ঠী: স্বজাতির বাইরে বিবাহ সাধারণত নিষিদ্ধ ছিল ।

3.  বৃত্তিবিভাগ: প্রত্যেক জাতির একটি নির্দিষ্ট পেশা ছিল, যা বংশপরম্পরায় অনুসরণ করা হতো (যেমন ব্রাহ্মণের পূজা-অর্চনা, কুমোরের মাটির কাজ) ।

​ইতিহাসে দেখা যায়, জাতি প্রথা উৎপাদন ও বণ্টনের একটি অ-প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যা সমাজের প্রয়োজন মেটানো এবং ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করত । ফলস্বরূপ, প্রাত্যহিক সামাজিক জীবনে বর্ণ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং জাতি-প্রথার ভিত্তিতে হিন্দু সমাজের কাঠামো গড়ে ওঠে । বাংলার মতো অঞ্চলে যেখানে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য শ্রেণি ছিল না, সেখানে ব্রাহ্মণগণও জাতি হিসেবে পরিগণিত হতেন ।

​৪.০। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাকার ও দার্শনিক বিতর্ক: ভক্তি আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ

​শাস্ত্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন মতবাদ ও আন্দোলন প্রতিবাদ জানিয়েছে।

​৪.১। আদি শঙ্করাচার্যের অবস্থান

​অষ্টম শতাব্দীর দার্শনিক আদি শঙ্করাচার্য (যিনি শৈব সংস্কারবাদী ছিলেন) তাঁর গীতা ভাষ্যের মাধ্যমে ধর্মগ্রন্থটিকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করেন । তিনি কর্মফল ও পুনর্জন্মের দর্শনকে সমর্থন করেন, যা পরোক্ষভাবে বর্ণাশ্রম ধারণাকে সমাজে স্থিতিশীলতা দিতে সাহায্য করে। যদিও তাঁর দর্শন অদ্বৈত বেদান্তের উপর জোর দেয়, তাঁর প্রভাব গীতার গ্রহণযোগ্যতাকে এমন স্তরে নিয়ে যায়, যা শ্রেণীগত মতাদর্শ প্রসারে পরোক্ষভাবে সহায়ক হয়েছিল।

​৪.২। ভক্তি আন্দোলনের বিপ্লব (The Bhakti Revolution)

​মধ্যযুগে বর্ণ প্রথা ও জটিল আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া এসেছিল ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে । দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণব ও শৈব সাধকদের মাধ্যমে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ।

​ভক্তি সাধকদের মূল শিক্ষা ছিল সাম্য ও ব্যক্তিগত ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ। তাঁরা ঘোষণা করেন যে, ঈশ্বর ব্যক্তিগত এবং তাঁকে লাভ করার জন্য জাতি, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থানের কোনো বাধা নেই । ভক্তি দর্শন জটিল আচার-অনুষ্ঠান, বৈদিক মন্ত্র পাঠ এবং পুরোহিতের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করে মোক্ষ লাভের জন্য প্রেমময় ভক্তিকে একমাত্র পথ হিসেবে গ্রহণ করে ।

​ভক্তি সাধকরা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বৈষ্ণবদের একটি তীব্র মত ছিল: "বৈষ্ণব দেখিয়া যেবা জাতি বুদ্ধি করে তাহার সমান পাপী নাহিক সংসারে" । ভক্তি আন্দোলন ছিল আধ্যাত্মিক পথের গণতান্ত্রিকীকরণ (Democratization of the Spiritual Path), কারণ এটি উচ্চ বর্ণের জন্য সংরক্ষিত দ্বিজত্বের অধিকার বা কঠিন শাস্ত্রীয় রীতিনীতি এড়িয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে সরাসরি আধ্যাত্মিক মুক্তির অধিকার এনে দেয়। এই আন্দোলন ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিল।




​৫.০। আধুনিক পণ্ডিত ও সংস্কারকদের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

​উনিশ ও বিশ শতকে বর্ণ প্রথা ভারতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে আসে। ড. বি. আর. আম্বেদকর ও স্বামী বিবেকানন্দের মতো ব্যক্তিত্ব এই কাঠামোর উপর কাঠামোগত প্রশ্ন উত্থাপন করেন।

​৫.১। ড. বি. আর. আম্বেদকর: বর্ণ ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও আইনি সংগ্রাম

​ড. বি. আর. আম্বেদকর ছিলেন জাতি প্রথার কঠোরতম সমালোচকদের মধ্যে একজন। তিনি হিন্দু সমাজের আমূল পরিবর্তন এবং জাতি প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি (Annihilation of Caste) চেয়েছিলেন। তাঁর সংগ্রাম প্রমাণ করে যে, সামাজিক প্রথার বিলুপ্তি কেবল ধর্মীয় বা দার্শনিক আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব নয়, এর জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং কঠোর আইনি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

​১৯৫০-এর দশকে যখন আইন মন্ত্রী হিসেবে আম্বেদকর হিন্দু কোড বিল লোকসভায় পেশ করেন, তখন দেশজুড়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয় । তিনি শাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বিধিতে নারীর সম্পত্তি উত্তরাধিকারের মতো (দায়ভাগ ও পিতৃসবর্ণ স্মৃতির উপর ভিত্তি করে) পুরনো নীতিগুলিই পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে, কোনো নতুন বিধান আনা হয়নি । রক্ষণশীল হিন্দুদের প্রবল বিরোধিতার মুখে বিলটি পাস না হওয়ায়, তিনি অতৃপ্তির কারণে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন । তাঁর রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেখিয়েছিল যে, জাতিভেদ প্রথা কেবল একটি সামাজিক অভ্যাস নয়, বরং এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের রক্ষক।

​৫.২। স্বামী বিবেকানন্দ: আদর্শ সমাজের কল্পনা ও শূদ্র যুগের অনিবার্যতা

​স্বামী বিবেকানন্দ জন্মভিত্তিক সঙ্কীর্ণতার বিরোধী ছিলেন এবং বর্ণসঙ্করা (Varnasankara) ধারণাকে কেবল জন্মভিত্তিক প্রথার ক্ষেত্রেই অর্থবহ বলে মনে করতেন ।

​বিবেকানন্দ সমাজ বিবর্তনের একটি চক্রাকার তত্ত্ব পেশ করেন, যেখানে সমাজ ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ (পুরোহিত), ক্ষত্রিয় (সৈনিক) ও বৈশ্য (ব্যবসায়ী) দ্বারা শাসিত হওয়ার পর অনিবার্যভাবে শূদ্র (মজুর বা সর্বহারা) শাসনের দিকে অগ্রসর হয় । তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, শূদ্র যুগে গরীবরা তাদের অসমান জীবন সংগ্রাম থেকে অনেকটাই সুবিধা পাবে, কিন্তু এই শূদ্র শাসনকেও তিনি সর্বোচ্চ বা আদর্শ শাসন ব্যবস্থা মনে করেননি ।

​তাঁর মতে, শোষণহীন একটি আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য সকল বর্ণের শ্রেষ্ঠ গুণের সমন্বয় প্রয়োজন: "ব্রাহ্মণ যুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয় সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ এই সব গুলি ঠিক ঠিক বজায় থাকবে, অথচ এদের দোষ গুলি থাকবে না" । তিনি মনে করতেন, সমাজের সকলেরই ব্রাহ্মণ হওয়া উচিত, কিন্তু এই 'ব্রাহ্মণ' শব্দটি ব্রহ্মজ্ঞানী বা ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য সচেষ্ট ব্যক্তি অর্থেই ব্যবহৃত । বিবেকানন্দের এই আহ্বান এবং শূদ্র যুগের অনিবার্যতা ঘোষণার মধ্যে সামাজিক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেখা যায়, যা আধুনিক সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

​৫.৩। মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য আধুনিক মতাদর্শ

​মহাত্মা গান্ধী বর্ণ ব্যবস্থার সংস্কার চাইলেও ধর্ম পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন । তিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়েছেন।

​সমাজবিজ্ঞানী লুই ডুমোঁ (Louis Dumont) জাতিপ্রথাকে ধর্মীয় পবিত্রতা-অপবিত্রতার ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে ব্যাখ্যা করেন । তবে আন্দ্র বেটেইল (André Beteille) এর মতো আধুনিক পণ্ডিতরা লক্ষ করেন যে শাস্ত্রীয় সাহিত্যে বর্ণ প্রাধান্য পেলেও বর্তমান সমাজে জাতি (Jati) প্রথা মুখ্য ভূমিকা পালন করে, যা জন্মভিত্তিক, অন্তঃবিবাহ গোষ্ঠী এবং পেশা দ্বারা নির্ধারিত ।

​৬.০। সমাজে প্রচলিত ভয়াবহ মিথ ও মুক্তির পথ

​বর্ণ প্রথাকে ঘিরে সমাজে এক শক্তিশালী ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে আছে, যা বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখে। এই মিথটি মূলত ঐশ্বরিক অনুমোদন এবং কর্মফলের মতো ধারণার উপর নির্ভরশীল।

​৬.১। মিথের স্বরূপ: ঐশ্বরিক অনুমোদন ও সিস্টেম জাস্টিফিকেশন

​সবচেয়ে ভয়াবহ মিথটি হলো, বর্ণভিত্তিক বৈষম্যকে ঐশ্বরিক বা প্রাকৃতিক (যেমন কর্মফল বা ধর্মীয় ম্যান্ডেট) বলে বিশ্বাস করা, যা নিপীড়ন ও অসমতাকে ন্যায্য বলে প্রমাণ করে ।

​মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সিস্টেম জাস্টিফিকেশন থিওরি দেখায় যে, মানুষ কখনও কখনও অচেতনভাবে নিপীড়ক সামাজিক ব্যবস্থাগুলিকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি মানসিক কাঠামো তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় নিম্ন বর্ণের মানুষজনও তাদের নিজস্ব নীচু অবস্থানকে গ্রহণ করে নেয়, কারণ এই ব্যবস্থাটি দীর্ঘকাল ধরে বৈধতা পেয়ে আসছে । এই ধর্মীয় মিথটি (যেমন, 'তোমার পূর্বজন্মের কর্মফলই তোমাকে এই জন্মে শূদ্র করেছে') নিম্ন বর্ণের মানুষকে বৈষম্য মেনে নিতে উৎসাহিত করে, যা সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ঢাল (Psychological Shield) হিসেবে কাজ করে।

​বাস্তবে দেখা যায়, জাতিভিত্তিক বৈষম্য কেবল সামাজিক মর্যাদার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বস্তুগত বৈষম্য তৈরি করে। নিম্ন বর্ণের মানুষেরা উৎপাদনশীল সম্পদের অসম প্রবেশাধিকার এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। এমনকি উচ্চশিক্ষিত নিম্ন বর্ণের সদস্যরাও সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের সম্মুখীন হন । বিভিন্ন সূচকে এখনও ব্রাহ্মণদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণে আধিপত্য দেখা যায় ।

​৬.২। মিথ থেকে পরিত্রাণ: জ্ঞানগত পুনর্বিচার ও সমষ্টিগত শিক্ষা

​এই ভয়াবহ মিথ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন জ্ঞানগত পুনর্বিচার ও সমাজের সমষ্টিগত শিক্ষা।

​১. আখ্যানের পুনর্লিখন: শত শত বছর ধরে এই প্রথাকে বৈধতা দেওয়া আখ্যানগুলিকে পুনর্লিখন করতে হবে। বর্ণপ্রথাকে একটি ঐশ্বরিক ম্যান্ডেট হিসাবে নয়, বরং উচ্চ বর্ণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সামাজিক নির্মাণ (Social Construct) হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন ।

২. সমষ্টিগত শিক্ষা: জনগণের মধ্যে অচেতন মানসিক কাঠামোটিকে শনাক্ত করে প্রত্যাখ্যানের জন্য সমষ্টিগত শিক্ষা আবশ্যক। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তিরা সেই মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোটি বর্জন না করবে, যা জাতিগত পদবিগুলিকে ধরে রাখে, ততক্ষণ প্রকৃত সমতা অধরা থাকবে ।

৩. কাঠামোগত পরিবর্তন: এই মিথের ফলে সৃষ্ট বস্তুগত বৈষম্য (Material Disadvantage) দূর করার জন্য অর্থনৈতিক ও আইনি স্তরে হস্তক্ষেপ জরুরি। উৎপাদনশীল সম্পদের অসম প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্যমূলক ফলাফলের বিরুদ্ধে সুচিন্তিত জননীতিগত লড়াই প্রয়োজন ।

​৬.৩। আইনি সংস্কারের সীমাবদ্ধতা

​ভারতের সংরক্ষণ নীতি (Reservations) ঐতিহাসিক বৈষম্য দূর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রচেষ্টা। তবে আইনি ব্যবস্থার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত টানাপোড়েন লক্ষ করা যায়। একদিকে সংবিধান সামাজিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, অন্যদিকে আদালত কখনও কখনও জাতি বা উপজাতির নিজস্ব সীমা নির্ধারণের কর্তৃত্বের প্রতি নমনীয়তা দেখায় । এই নমনীয়তা সাম্যের আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে এবং শ্রেণিগত কর্তৃত্বকে পুনরায় বৈধতা দিতে পারে। তাই জাতি প্রথা বিলুপ্তির প্রচেষ্টায় আইনি হস্তক্ষেপের পাশাপাশি মানসিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও অপরিহার্য।

​৭.০। উপসংহার ও সুপারিশ

​৭.১। বর্ণ প্রথার সারসংক্ষেপ

​হিন্দু ধর্মের বর্ণ প্রথা, যা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত, তা শাস্ত্রীয় আদর্শ (গুণ ও কর্মভিত্তিক Varna) থেকে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় (জন্মভিত্তিক, কঠোর Jati) বিকৃত হয়েছে। ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্তের প্রক্ষেপণ বিতর্ক এবং মনুসংহিতার কঠোর বিধান এই বিকৃতিকে জন্ম দিয়েছে। মনুসংহিতা এবং কুল্লুক ভট্টের মতো ভাষ্যকারগণ জন্মভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বকে শক্তিশালী করে ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্যযুগে ভক্তি আন্দোলন এবং আধুনিক কালে ড. বি. আর. আম্বেদকর ও স্বামী বিবেকানন্দের মতো সংস্কারকগণ এই সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম করেছেন। বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের মূলে রয়েছে একটি মিথ, যা বৈষম্যকে ঐশ্বরিক বা প্রাকৃতিক বলে ন্যায্যতা দেয়, যার ফলে সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় থাকে এবং বস্তুগত বৈষম্য স্থায়ী হয়।

​৭.২। মুক্তির পথ ও দিকনির্দেশ

​সমাজের মিথ এবং বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য একটি বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করা আবশ্যক:

​১. মনস্তাত্ত্বিক ও শিক্ষামূলক পুনর্বিচার: বর্ণ প্রথার উৎপত্তি ও বিবর্তনের প্রকৃত ইতিহাস পাঠক্রমের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে। কর্মফল ও ঐশ্বরিক ম্যান্ডেটের নামে প্রচারিত বৈষম্যের আখ্যানগুলিকে ঐতিহাসিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করা এবং সেগুলিকে সামাজিক নির্মাণ হিসেবে চিহ্নিত করা অপরিহার্য।

২. কাঠামোগত ন্যায়বিচার: ড. বি. আর. আম্বেদকরের পথ অনুসরণ করে কেবল সামাজিক মর্যাদা নয়, বরং উৎপাদনশীল সম্পদের অসম প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্যমূলক ফলাফলের (inequality of outcomes) বিরুদ্ধে জননীতিগত লড়াই প্রয়োজন।

৩. সমন্বয়ের আদর্শ: স্বামী বিবেকানন্দের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি আদর্শ সমাজ গঠনের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত, যেখানে ব্রাহ্মণ যুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয় সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি, এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ—সকলের শ্রেষ্ঠ দিকগুলির সমন্বয় ঘটবে এবং কোনো শোষণ বা বৈষম্য থাকবে না। এটিই সামাজিক গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ। 




No comments:

Post a Comment