Sunday, 7 December 2025

Shrimad Bhagavad Gita Versus Ashtavakra Gita: A Comparative Analysis of Spiritual Paths for Humanity( শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বনাম অষ্টাবক্র গীতা: মানব জাতির জন্য আধ্যাত্মিক পথের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ)






শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বনাম অষ্টাবক্র গীতা: মানব জাতির জন্য আধ্যাত্মিক পথের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

1. ভূমিকা: তুলনামূলক আলোচনার প্রেক্ষাপট ও পরিধি

ভারতীয় আধ্যাত্মিক সাহিত্যে 'গীতা' নামে পরিচিত বহু গ্রন্থ থাকলেও, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (BG) এবং অষ্টাবক্র গীতা (AG) এই দুটি পাঠ্য আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত। উভয় গ্রন্থই চূড়ান্ত জ্ঞান (জ্ঞান) এবং মুক্তির (মোক্ষ) পথ নির্দেশ করে, তবুও তাদের দার্শনিক পদ্ধতি, ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা এবং মানবজাতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তাদের আপীল ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় পরিমাপযোগ্য। এই প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য হলো, শাস্ত্রীয়, ঐতিহাসিক এবং আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুই গীতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে মানবজাতির জন্য তাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণ করা।

1.1. গীতাসমূহের ঐতিহাসিক পটভূমি ও সংজ্ঞা

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, যা সচরাচর 'গীতা' নামেই পরিচিত, হলো মহাভারত মহাকাব্যের একটি ১৮ অধ্যায় বিশিষ্ট অংশ, যা প্রায় ৭০০ শ্লোক দ্বারা গঠিত । ঐতিহাসিকরা এর রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা প্রথম শতাব্দীতে অনুমান করেন । এই গ্রন্থটি কেবল একটি দার্শনিক আলোচনা নয়, বরং এটি বৈদিক ধর্ম (কর্তব্য), সাংখ্য-যোগের জ্ঞান এবং ভক্তি (ঈশ্বরকে সমর্পণ) সহ ভারতীয় ধর্মীয় চিন্তাধারার বিভিন্ন উপাদানের একটি গভীর সংশ্লেষণ । এটি বৈষ্ণব ও বেদান্ত ঐতিহ্যের একটি কেন্দ্রীয় শাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত ।

অন্যদিকে, অষ্টাবক্র গীতা বা অষ্টাবক্র সংহিতা হলো ঋষি অষ্টাবক্র এবং মিথিলার ধর্মপরায়ণ রাজা জনকের মধ্যেকার একটি কথোপকথন । এটি মূলত একটি উচ্চমাত্রার অদ্বৈত গ্রন্থ, যা অন্য কোনো মহাকাব্য বা মূল ধর্মীয় ক্যাননের অংশ নয়। এর রচনাকাল পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কিত; কিছু গবেষক এটিকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের কাছাকাছি রাখলেও, কেউ কেউ একে অষ্টম বা এমনকি চতুর্দশ শতাব্দীতে শঙ্কর-অনুসারীদের দ্বারা রচিত বলে মনে করেন । এই অনিশ্চিত কালনির্ণয় এটিকে প্রস্থানত্রয়ী বা শাস্ত্রীয় প্রামাণিকতার মূল স্রোতে আসার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে।

1.2. প্রামাণিকতা ও উদ্দেশ্য

ভগবদ্গীতার উদ্দেশ্য হলো জীবনের তীব্র নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং জাগতিক জটিলতার মধ্যে থেকেও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা দিয়ে জীবন পরিচালনা করার একটি ব্যাপক নির্দেশিকা প্রদান করা । কৃষ্ণ এখানে অর্জুনকে তার কর্তব্য (ধর্ম) পালন করতে এবং কর্মের ফল ঈশ্বরের কাছে অর্পণ করতে উৎসাহিত করেন ।

বিপরীতে, অষ্টাবক্র গীতা হলো জ্ঞানমার্গের জন্য রচিত একটি 'ট্রান্সসেন্ডেন্টাল সাহিত্য' । এটি বিশেষভাবে উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন সাধক (সাধক) বা 'উত্তমাধিকারীর' জন্য নির্ধারিত, যাদের চিত্তশুদ্ধি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে । এই পাঠ্যের উদ্দেশ্য হলো—ধীরে ধীরে অগ্রসর না হয়ে সরাসরি আত্ম-উপলব্ধির চরম সত্যে প্রবেশ করা।

2. মূল দার্শনিক ভিত্তি ও পদ্ধতির তুলনা: পথপ্রদর্শক বনাম লক্ষ্য

উভয় গীতার মূল বিষয়বস্তু অভিন্ন হলেও—অর্থাৎ ঈশ্বর বা আত্মার প্রতি মনোনিবেশ করা —তাদের শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতিগত দিকগুলি এই দুই গ্রন্থের গুরুত্বের পার্থক্য নির্ণয় করে।

2.1. প্রসঙ্গ ও পরিবেশের ভিন্নতা

দুই গীতার সংলাপের প্রেক্ষাপট তাদের শিক্ষাদান কৌশলের ধরনকে অপরিহার্যভাবে প্রভাবিত করেছে।

 * ভগবদ্গীতা: এর প্রেক্ষাপট হলো কুরুক্ষেত্রের রণভূমি, যা তাৎক্ষণিক কর্ম এবং গভীর নৈতিক দ্বিধার প্রতীক । এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে, শ্রীকৃষ্ণকে অর্জুনের ব্যক্তিগত ধর্ম (দায়িত্ব) এবং বিশ্বব্যাপী ধর্ম রক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে একত্রিত করে শিক্ষা দিতে হয়েছে । এই প্রেক্ষাপটেই কৃষ্ণ লোকসংগ্রহের মতো সামাজিক মূল্যবোধকে মুক্তির প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছেন ।

 * অষ্টাবক্র গীতা: এর প্রেক্ষাপট রাজা জনকের শান্ত, চিন্তামূলক রাজসভা, যেখানে একজন দার্শনিক অনুসন্ধান চলছে । জনক একজন রাজর্ষি হিসেবে ইতোমধ্যে উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন । এই পরিবেশ অষ্টাবক্রকে জাগতিক কর্ম এবং সামাজিক ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল চূড়ান্ত অদ্বৈত জ্ঞানের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ দিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটের পার্থক্য নির্দেশ করে যে ভগবদ্গীতা জীবনের চারটি লক্ষ্য (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) সমন্বিত মানবজীবনের জন্য নকশা করা হয়েছে, যেখানে অষ্টাবক্র গীতা শুধুমাত্র মোক্ষের উপর সরাসরি জোর দেয়।

2.2. দর্শনের পদ্ধতিগত পার্থক্য

পদ্ধতির দিক থেকে, ভগবদ্গীতা সমন্বয় এবং ধীরে ধীরে অগ্রগতির পথ দেখায়, যা একে একটি 'মাল্টি-কোর্স মিল'-এর সঙ্গে তুলনীয় করে । এটি কর্ম যোগের মাধ্যমে অনাসক্তি, ভক্তি যোগের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধি, এবং জ্ঞান যোগের মাধ্যমে জ্ঞান—এইভাবে মনের পরিবর্তনকে একটি যাত্রা হিসেবে বর্ণনা করে ।

বিপরীতে, অষ্টাবক্র গীতা আমূল অদ্বৈতবাদকে তুলে ধরে। এটি 'ডিনার টেবিলকে সরিয়ে দেয়' । এটি সরাসরি ঘোষণা করে যে আত্মা চিরন্তনভাবে মুক্ত এবং দেহ বা মন দ্বারা অনাবদ্ধ । এটি শেখায় যে মুক্তি কোনো সুশৃঙ্খল পদক্ষেপের মাধ্যমে আরোহণ করা দূরবর্তী চূড়া নয়, বরং এটি প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্যমান । এর তীক্ষ্ণ সারল্য (crisp minimalism) এটিকে একটি 'জেন কোয়ানের' মতো করে তোলে, যা কোনো আনুষ্ঠানিকতা, স্তরক্রম বা বিলম্ব ছাড়াই স্বাধীনতার দিকে ইঙ্গিত করে । এই সরাসরি পদ্ধতিটি সেই সাধকদের জন্য যারা মনন এবং নিদিধ্যাসনের চূড়ান্ত স্তরে অবস্থান করেন ।

2.3. ঈশ্বরের ধারণা ও স্তরক্রম

ভগবদ্গীতা পরম সত্যের একটি স্তরক্রম বর্ণনা করে। এটি ব্যক্তিগত ঈশ্বর (সগুণ ব্রহ্ম), শ্রীকৃষ্ণকে সর্বোচ্চ সত্য হিসেবে সরাসরি উপস্থাপন করে । কৃষ্ণ ভক্তিকে চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন । যদিও এটি নির্গুণ ব্রহ্মের কথা বলে, তবুও এটি ভক্তি ও পরমাত্মার মাধ্যমে উপলব্ধি করা সগুণ ঈশ্বরের ধারণাটিকে শীর্ষে রাখে।

পক্ষান্তরে, অষ্টাবক্র গীতা সাধারণত ব্যক্তিগত ঈশ্বর বা ভক্তিকে কেন্দ্রীয় পথ হিসেবে গ্রহণ করে না, বরং নির্গুণ ব্রহ্ম বা শুদ্ধ চেতনার উপর একচেটিয়াভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এটি সাধককে তার নিজের প্রকৃত প্রকৃতিকে 'অনিয়ন্ত্রিত, অপরিবর্তনীয়, নিরাকার, অচল চেতনা' হিসেবে উপলব্ধি করার আহ্বান জানায় ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (BG) এবং অষ্টাবক্র গীতা (AG) উভয়ই ভারতীয় দর্শনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র হলেও তাদের মূল পদ্ধতি ও শ্রোতার যোগ্যতার ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। BG-এর মূল পদ্ধতি হলো সমন্বয়মূলক, যেখানে এটি জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ এবং ভক্তিযোগ—এই তিন পথকে সমন্বয় করে। গীতা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উন্নত সাধক পর্যন্ত ব্যাপক শ্রোতার কথা মাথায় রেখে রচিত হয়েছে এবং অনাসক্তভাবে কর্তব্য পালনের মাধ্যমে লোকসংগ্রহ (জগতের কল্যাণ) এবং ধর্ম রক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়। তাই এটি জীবনের জটিলতা ও দ্বন্দ্ব মোকাবিলার জন্য একটি ব্যাপক নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে, অষ্টাবক্র গীতার (AG) মূল পদ্ধতি হলো প্রত্যক্ষ জ্ঞান মার্গের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা আমূল অদ্বৈত বেদান্তকে সরাসরি নির্দেশ করে। AG শুধুমাত্র উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন শ্রোতাদের—যারা তীব্র বৈরাগ্য ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাযুক্ত—তাদের জন্যই উদ্দিষ্ট। এই শাস্ত্র জাগতিক কর্মের নিবৃত্তি বা চরম ত্যাগকে প্রধান্য দেয় এবং আত্ম-উপলব্ধি বা ব্রহ্মজ্ঞানের একটি সরাসরি ও নির্ভুল পথ হিসেবে বিবেচিত হয়।

3. কর্ম, ধর্ম এবং লোকসংগ্রহের প্রশ্ন: সামাজিক দায়বদ্ধতা

মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বরং সামাজিক এবং নৈতিক কাঠামোর স্থিতিশীলতাও প্রয়োজন। এই বিষয়ে দুটি গীতার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

3.1. BG-এর লোকসংগ্রহের দর্শন

ভগবদ্গীতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক অবদান হলো লোকসংগ্রহ (বিশ্বকল্যাণ) এবং অনাসক্ত কর্মের উপর জোর দেওয়া । শ্রীকৃষ্ণ জোর দেন যে জ্ঞানী ব্যক্তিকেও কর্ম করতে হবে, তবে তা হবে সমাজের মঙ্গলের জন্য—ফলের প্রতি কোনো আসক্তি না রেখে । এই শিক্ষায় বলা হয়েছে যে জ্ঞানীরা এমনভাবে কাজ করবেন যাতে অজ্ঞ ব্যক্তিরা যেন সমাজ এবং কর্মের প্রতি তাদের বিশ্বাস না হারায় । লোকসংগ্রহের ধারণাটি একটি উচ্চ নৈতিক ও সামাজিক মূল্য, যা আত্ম-স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে মানবজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করার একটি পথ দেখায় । এই কাঠামোটি গৃহস্থ বা রাজার মতো সামাজিক ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য আধ্যাত্মিক অগ্রগতি সম্ভব করে তোলে, যা মানব সমাজের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

3.2. AG-এর কর্মের নিবৃত্তি ও চূড়ান্ত বৈরাগ্য

অষ্টাবক্র গীতার শিক্ষা চরম বৈরাগ্যের দিকে নিয়ে যায়। জ্ঞান অর্জনের পরে সাধকের কর্মে আর কোনো আগ্রহ থাকে না। এই গ্রন্থে উপদেশ দেওয়া হয়েছে, 'তুমি সব ভুলে যেতে না পারলে তোমার অন্তঃকরণে প্রতিষ্ঠিত হবে না' । জ্ঞান লাভকারী ব্যক্তি নিজের দেহ বা কর্মের প্রতি কোনো আসক্তি বা প্রত্যাখ্যান দেখান না এবং 'যেমন ইচ্ছা' জীবন যাপন করেন । এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আলস্যও মুক্তির পথে বাধা নয়: "সুখ তার জন্যই, যে চরম অলস, যার কাছে এমনকি চোখ খোলা ও বন্ধ করাও কষ্টের" ।

3.3. সামাজিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা

অষ্টাবক্র গীতার এই চরম বৈরাগ্যের বার্তাটি যদি মানব জাতির বৃহত্তর অংশের জন্য প্রাথমিক উপদেশ হিসেবে গৃহীত হয়, তবে তার পরিণতি সামাজিক বিশৃঙ্খলার দিকে ঝুঁকতে পারে। যে ব্যক্তিরা এখনও জাগতিক আসক্তি থেকে মুক্ত হননি, তারা জ্ঞান লাভের আগেই কর্তব্য (ধর্ম) থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে, যা সামাজিক দায়িত্ববোধের অবসান ঘটাতে পারে।

ভগবদ্গীতা এই সম্ভাব্য ঝুঁকিকে সক্রিয়ভাবে এড়িয়ে যায়। লোকসংগ্রহের মাধ্যমে, এটি দেখায় যে কর্মের মাধ্যমেই বন্ধনমুক্ত হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, মানব সমাজের টিকে থাকা, নৈতিক শৃঙ্খলা এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কর্তব্য ও মুক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে, ভগবদ্গীতার সমন্বয়মূলক নৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক অষ্টাবক্র গীতার জ্ঞানমূলক ঘোষণার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য।

4. শাস্ত্রীয় আচার্য ও প্রাচীন দার্শনিকদের অবস্থান

ঐতিহাসিকভাবে শাস্ত্রীয় আচার্যদের ভাষ্য এবং তাদের অনুমোদন একটি গ্রন্থের প্রামাণিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করে।

4.1. বেদান্ত আচার্যদের মত ও ভাষ্য

ভগবদ্গীতা হলো প্রস্থানত্রয়ী (উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র, গীতা) এর অন্যতম অংশ হিসেবে স্বীকৃত । এই মর্যাদার কারণে, আদি শঙ্কর, রামানুজাচার্য, এবং মধবাচার্যের মতো প্রধান বেদান্ত আচার্যরা ভগবদ্গীতার ওপর বিশদ ভাষ্য রচনা করেছেন । এই ভাষ্যগুলি গীতাকে হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন ধারার (অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈত) একটি কেন্দ্রীয় ও প্রামাণিক পাঠ্য হিসেবে বৈধতা দিয়েছে। যেমন, রামানুজাচার্যের ব্যাখ্যায় ভক্তি যোগকে গীতার মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ।

অষ্টাবক্র গীতা উচ্চ অদ্বৈত গ্রন্থ হওয়া সত্ত্বেও, শাস্ত্রীয় বেদান্তের ত্রয়ী আচার্যদের কোনো আনুষ্ঠানিক ভাষ্য এর ওপর পাওয়া যায় না। এটি ইঙ্গিত করে যে, শাস্ত্রীয় প্রামাণিকতার মূল ধারায় এটি একটি প্রান্তিক অবস্থানে ছিল, যা কেবল চরম অদ্বৈত ঐতিহ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ।

4.2. আধুনিক সাধকদের দৃষ্টিতে জ্ঞানযোগের শ্রেষ্ঠত্ব

বিংশ শতকের আধুনিক সাধক এবং আত্ম-অনুসন্ধানের প্রবক্তারা জ্ঞানযোগের উপর জোর দেওয়ায় অষ্টাবক্র গীতার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

 * শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নরেন্দ্রনাথকে (স্বামী বিবেকানন্দ) অষ্টাবক্র গীতা পাঠ করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, যা তাঁর অদ্বৈতবাদী উপলব্ধিকে দৃঢ় করেছিল ।

 * রমণ মহর্ষি: রমণ মহর্ষি, যিনি আত্ম-অনুসন্ধান (Self-Inquiry) পদ্ধতির মাধ্যমে সরাসরি জ্ঞান লাভের ওপর জোর দিতেন, তিনি অষ্টাবক্র গীতাকে 'direct truth' প্রদানকারী গ্রন্থ হিসেবে প্রশংসা করেন । তিনি স্বয়ং এই গ্রন্থের সংস্কৃত পাঠ তাঁর হস্তাক্ষরে লিখেছিলেন ।

এই আধুনিক সাধকদের কাছে, অষ্টাবক্র গীতার গুরুত্ব হলো এর অভিজ্ঞতামূলক দিক, যা দীর্ঘ সাধনার মধ্য দিয়ে না গিয়ে সরাসরি উপলব্ধি অর্জনে সহায়ক। এটি দেখায় যে অষ্টাবক্র গীতা প্রথাগত কর্তৃত্বের চেয়ে ব্যক্তিগত, গভীর উপলব্ধির মাধ্যমে তার প্রামাণিকতা অর্জন করেছে।

5. আন্তর্জাতিক ইন্ডোলজিস্ট এবং কালনির্ধারণের বিতর্ক

বিশ্বব্যাপী প্রভাবের ক্ষেত্রে ভগবদ্গীতার অবস্থান অতুলনীয়।

5.1. পশ্চিমাদের দ্বারা BG-এর আবিষ্কার ও বিশ্বায়ন

ভগবদ্গীতার বিশ্বজনীন খ্যাতি মূলত পশ্চিমা পণ্ডিতদের 'আবিষ্কারের' ফল। ১৭৮৪ সালে উইলিয়াম জোনসের মাধ্যমে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা এবং চার্লস উইলকিন্স কর্তৃক ভগবদ্গীতার প্রথম ইউরোপীয় অনুবাদ (Bhagavat-Geetâ) প্রকাশের পর এটি ইউরোপে ব্যাপক সাড়া ফেলে । এই গ্রন্থটিকে বাইবেলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল, এবং এটি বিশ্বব্যাপী হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পরিচিত এবং প্রভাবশালী পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় । এই ব্যাপক বৈশ্বিক প্রচলন এটিকে মানবজাতির আধ্যাত্মিক আলোচনায় একটি প্রধান স্থান দিয়েছে।

5.2. AG-এর কালক্রমিক বিতর্ক

অষ্টাবক্র গীতার কালক্রমিক বিতর্ক (৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৪শ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন মত) এর মৌলিকতার বিষয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। যদি এটি শঙ্কর-পরবর্তী হয়, তবে এর দার্শনিক বিষয়বস্তু কেবল পূর্ববর্তী অদ্বৈত চিন্তাধারার সংকলন হবে। এই বিতর্ক ভগবদ্গীতার সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক মর্যাদার বিপরীতে অষ্টাবক্র গীতার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকে সীমিত করেছে।

6. বর্তমান আধ্যাত্মিক সমাজ ও ব্যবহারিক প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান সময়ে, আধ্যাত্মিক সমাজ দ্রুত, সরাসরি এবং আনুষ্ঠানিকতামুক্ত জ্ঞান লাভের দিকে আগ্রহী।

6.1. ব্যবহারিক দিকনির্দেশিকা বনাম চূড়ান্ত জ্ঞান

ভগবদ্গীতা আধুনিক যুগের মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাগুলির জন্য কার্যকর উত্তর প্রদান করে । এটি জীবনের সমস্ত পথে আধ্যাত্মিকতা কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তার নির্দেশনা দেয় । অনেক সাধক মনে করেন, কলিযুগের জন্য ভগবদ্গীতার শিক্ষাই যথেষ্ট ।

অন্যদিকে, অষ্টাবক্র গীতা দ্রুত ফল লাভের মানসিকতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এটি একধরনের 'stripped-down approach', যা বর্তমানে 'মাইন্ডফুলনেস' বা দ্রুত উপলব্ধির সন্ধানে থাকা মানুষের কাছে খুবই আকর্ষণীয় । এই গ্রন্থটি কোনো দীর্ঘ, কঠিন প্রক্রিয়া বা পরম্পরার কথা বলে না, বরং সরাসরি ঘোষণা করে যে মুক্তি ইতিমধ্যেই বিদ্যমান—যা বর্তমান সময়ের 'ইনস্ট্যান্ট রিয়ালাইজেশন'-এর ধারণার সঙ্গে মিলে যায় ।

6.2. Neo-Advaita-এর দৃষ্টিকোণ

আধুনিক Neo-Advaita আন্দোলন অষ্টাবক্র গীতার বার্তাকে গ্রহণ করেছে। তারা মনে করে, ভগবদ্গীতা যেমন কর্ম যোগ বা ভক্তি যোগের মাধ্যমে মনকে প্রস্তুত করার একটি পদ্ধতি দেখায়, অষ্টাবক্র গীতা ঠিক তেমনি 'সূক্ষ্মতম অজ্ঞতা' সরাসরি দূর করার জন্য উপযোগী । যদিও এই বার্তা অত্যন্ত শক্তিশালী, ঐতিহ্যবাহী পণ্ডিতরা সতর্ক করেন যে এটি কেবল তাদের জন্যই ফলপ্রসূ যারা ইতিমধ্যেই শ্ৰবণ এবং মননের স্তর অতিক্রম করে নিদিধ্যাসনের স্তরে আছেন ।

7. চূড়ান্ত সংশ্লেষণ ও মানব জাতির জন্য গুরুত্ব নির্ধারণ

মানবজাতির জন্য এই দুই গীতার আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণে তাদের উদ্দেশ্য এবং আপিলের বিস্তৃতি বিবেচনা করা অপরিহার্য।

অষ্টাবক্র গীতা হলো জ্ঞানমার্গের মুকুটমণি। এটি চূড়ান্ত সত্যের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ, তীক্ষ্ণ এবং বিশুদ্ধ বর্ণনা প্রদান করে। এটি একজন 'উত্তমাধিকারী' সাধকের জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ, যিনি সমস্ত জাগতিক কর্ম ও ধর্ম অতিক্রম করে গেছেন এবং কেবল আত্ম-উপলব্ধি চান। এটি চূড়ান্ত গন্তব্যের চিত্রটি দেখায়।

কিন্তু মানব জাতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে—যেখানে বেশিরভাগ মানুষ জাগতিক দায়িত্ব (Dharma), জীবিকা এবং সমাজের সঙ্গে যুক্ত—সেখানে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার গুরুত্বের কারণ:

১. সমন্বয় ও সার্বজনীনতা: ভগবদ্গীতা জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির একটি কার্যকর সংশ্লেষণ প্রদান করে। এটি সকল প্রকার মানুষ, তাদের যোগ্যতা এবং জীবনের পরিস্থিতি নির্বিশেষে, তাদের জন্য আধ্যাত্মিক পথ উন্মুক্ত করে ।

২. নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি: ভগবদ্গীতার লোকসংগ্রহের উপর জোর মানব সমাজের নৈতিক ভিত্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য একটি অপরিহার্য কাঠামো প্রদান করে । এটি কর্ম থেকে সম্পূর্ণ নিবৃত্তির বিপদ থেকে সমাজকে রক্ষা করে, জ্ঞানী ব্যক্তিকে সমাজে সক্রিয়ভাবে এবং নিঃস্বার্থভাবে যুক্ত রাখে ।

৩. ঐতিহাসিক ও বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা: ভগবদ্গীতা শাস্ত্রীয় আচার্যদের মাধ্যমে প্রামাণিকতা লাভ করেছে এবং বৈশ্বিক প্রচলনের মাধ্যমে এটি মানবজাতির আধ্যাত্মিক ইতিহাসের একটি কেন্দ্রীয় পাঠ্য হিসেবে স্বীকৃত ।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত:

অষ্টাবক্র গীতা মোক্ষের শিখর হলেও, ভগবদ্গীতা মানবজাতির অস্তিত্বের সংগ্রাম, নৈতিক কাঠামো এবং আধ্যাত্মিক যাত্রাপথের ভিত্তি স্থাপন করে। ভগবদ্গীতা হলো জীবনের যাত্রাপথের জন্য সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য সংবিধান ও গাইডবুক, যা মানুষকে কর্তব্য ও মুক্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে শেখায়। এই কারণে, মানবজাতির বৃহত্তর নৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অগ্রগতির জন্য, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র।


Written by Suman Das 






Saturday, 6 December 2025

Caste System of Hinduism: Critical Review (হিন্দু ধর্মের বর্ণ প্রথা: শাস্ত্র, সমাজ এবং সমালোচনামূলক পর্যালোচনা)


 

হিন্দু ধর্মের বর্ণ প্রথা: শাস্ত্র, সমাজ এবং সমালোচনামূলক পর্যালোচনা

ধর্মের বর্ণ প্রথা: শাস্ত্র, বিবর্তন ও সংস্কার

​১.০। মুখবন্ধ: বর্ণ প্রথা ও জাতিরূপ মিথের বিশ্লেষণ

​হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভাজনের যে প্রচলিত প্রথা বিদ্যমান, তা প্রায়শই ধর্মীয় পবিত্রতা, কঠোর সামাজিক গতিহীনতা এবং জন্মভিত্তিক বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই শ্রেণিবিন্যাস ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত বিষয়, যেখানে দার্শনিক আদর্শ ও কঠোর সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এই প্রতিবেদন বর্ণ প্রথার উৎস, এর শাস্ত্রীয় ভিত্তি, ঐতিহাসিক বিবর্তন, এবং যুগে যুগে বিভিন্ন ভাষ্যকার ও সংস্কারকদের মতামতের একটি গভীর বিশ্লেষণ প্রদান করে।

​১.১। গবেষণাটির উদ্দেশ্য, পরিপ্রেক্ষিত ও কাঠামোগত ভূমিকা

​এই প্রতিবেদনের প্রধান লক্ষ্য হলো বর্ণ প্রথাকে কেবল একটি ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা হিসেবে না দেখে, বরং সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা। বিশেষত, তাত্ত্বিক ‘বর্ণ’ (Varna) ব্যবস্থা কীভাবে জন্মভিত্তিক ‘জাতি’ (Jati/Caste) প্রথার কঠোর রূপ ধারণ করল, সেই ঐতিহাসিক ফাটলটি চিহ্নিত করা এই গবেষণার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। প্রচলিত সামাজিক মিথ (myth) থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়গুলিও এখানে আলোচনা করা হবে, যা এই প্রথাকে এক ভয়াবহ সামাজিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

​১.২। শব্দার্থগত বিভাজন: ‘বর্ণ’ বনাম ‘জাতি’ (Varna vs. Jati/Caste)

​সমাজতত্ত্ব ও ধর্মীয় পাঠের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বর্ণ’ এবং ‘জাতি’র মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য না বোঝার ফলেই সমাজে এক ভয়াবহ ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে।

​১.২.১। বর্ণ (Varna)

​বর্ণ বলতে তাত্ত্বিকভাবে চারটি শ্রেণিতে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) বিভাজনকে বোঝায়। শাস্ত্রীয় গ্রন্থ, বিশেষত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা , অনুসারে এই শ্রেণিবিন্যাস গুণ (Guna) এবং কর্মের (Karma) ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণরা জ্ঞান ও শিক্ষাচর্চার মাধ্যমে, ক্ষত্রিয়রা শাসন ও রক্ষার মাধ্যমে, বৈশ্যরা ব্যবসা ও উৎপাদনের মাধ্যমে এবং শূদ্ররা সেবাকর্মের মাধ্যমে সমাজের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার জন্য নির্ধারিত ছিল । শাস্ত্রীয়ভাবে এই ব্যবস্থায় নমনীয়তা এবং ব্যক্তির যোগ্যতা অনুযায়ী স্থান পরিবর্তনের সুযোগ থাকা উচিত ছিল।

​১.২.২। জাতি (Jati/Caste)

​অন্যদিকে, জাতি হলো বাস্তব সামাজিক একক, যা জন্মভিত্তিক, বংশানুক্রমিক এবং অঞ্চল ও পেশাভেদে হাজার হাজার উপ-জাতিতে বিভক্ত । জাতি প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বংশানুক্রমিকতা, যেখানে একজন ব্যক্তি যে জাতিতে জন্মগ্রহণ করে, তাকে আজীবন সেই পরিচয়েই বহন করতে হয় । এছাড়াও এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো অন্তর্বিবাহ গোষ্ঠী (Endogamy), নির্দিষ্ট পেশা, এবং পবিত্রতা-অপবিত্রতা (Purity and Pollution) সংক্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে এক জটিল ক্রমোচ্চ শ্রেণী বিন্যাস ।

​ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, যদিও ধ্রুপদী হিন্দু সাহিত্যে বর্ণ (Varna) প্রথার কথা প্রায়শই উল্লিখিত হয়েছে, সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের মতে আধুনিক সময়ে জাতি (Jati) প্রথাই সামাজিক ভূমিকা পালন করে । এই জাতি প্রথার অস্তিত্বের প্রমাণ তুলনামূলকভাবে দেরিতে পাওয়া যায় । সমাজ যখন একটি নমনীয়, গুণ-কর্মভিত্তিক আদর্শ (Varna) থেকে একটি কঠোর, জন্মভিত্তিক কাঠামোর (Jati) দিকে সরে যায়, তখন এই বৈষম্যকে বৈধতা দেওয়ার জন্য একটি তাত্ত্বিক ছদ্মবেশ হিসেবে ওই আদর্শের অপব্যাখ্যা শুরু হয়। ফলে এই বিভাজনকে ঐশ্বরিক বা প্রাকৃতিক বলে মনে করার ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়।

​২.০। বর্ণ প্রথার মূল শাস্ত্রীয় উৎস অনুসন্ধান: ঋগ্বেদ ও গীতা

​বর্ণ প্রথার উৎসের সন্ধান করতে গেলে প্রাচীনতম শাস্ত্র, বেদ এবং পরবর্তীকালে জনপ্রিয় ধর্মগ্রন্থ গীতার দিকে দৃষ্টি দিতে হয়।

​২.১। ঋগ্বেদীয় উৎস: পুরুষ সূক্ত (RV 10.90.12) ও প্রক্ষেপণ বিতর্ক

​বর্ণ প্রথার ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক যৌক্তিকতার ভিত্তি হিসেবে সাধারণত ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সূক্তের (১০.৯০.১২) উল্লেখ করা হয় । এই মন্ত্রে বিরাট পুরুষের যজ্ঞ থেকে সমাজের চারটি শ্রেণির উদ্ভব দেখানো হয়েছে: মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি । প্রতীকীভাবে এটি একটি শ্রমবিভাগের ধারণা দেয়।

​তবে, এই সূক্তের মৌলিকতা নিয়ে পণ্ডিত সমাজে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। অনেক পণ্ডিত মনে করেন পুরুষ সূক্ত ঋগ্বেদের তুলনামূলকভাবে পরবর্তী সংযোজন বা প্রক্ষেপণ (Interpolation)। এর প্রধান যুক্তিগুলি হলো:

​১. ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক প্রমাণ: ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন সূক্তটির ভাষা ও ব্যাকরণ ঋগ্বেদের অন্যান্য অংশের তুলনায় উন্নত বা অপেক্ষাকৃত আধুনিক ।

২. একমাত্র উল্লেখ: এটি ঋগ্বেদের একমাত্র স্তোত্র যেখানে চারটি বর্ণের (Varna) স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ।

৩. সামাজিক কারণ: স্টেফানি জেমিসন এবং জোয়েল ব্রেটটনসহ অন্যান্য পণ্ডিতরা মন্তব্য করেছেন যে ঋগ্বেদে একটি বিস্তারিত, বহু-বিভক্ত বর্ণ ব্যবস্থার কোনো প্রমাণ নেই। তাঁরা মনে করেন যে ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসাম্যকে ধর্মীয় অনুমোদন দিতেই এই স্তোত্র পরবর্তীকালে যুক্ত করা হয়েছিল । ভারতীয় ঐতিহাসিক সুভিরা জয়সওয়াল এবং ড. বি. আর. আম্বেদকরও পুরুষ সূক্তকে ঋগ্বেদের প্রক্ষেপণ বলে মনে করতেন ।

​এই বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে প্রাচীনতম বৈদিক সমাজে বর্ণভিত্তিক কঠোর hierarchy সম্ভবত ছিল না। বর্ণ প্রথাকে আদি বা মৌলিক সত্য বলার দাবি এই প্রক্ষেপণ বিতর্কের মাধ্যমে দুর্বল হয়ে যায়।

​২.২। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দর্শন: গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি

​বর্ণ প্রথা নিয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়। শ্রীকৃষ্ণ চতুর্থ অধ্যায়ের ত্রয়োদশ শ্লোকে ঘোষণা করেন যে, "চাতুর্বর্ণ্য গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও" [৪.১৩]।

​গীতায় বর্ণের বিভাজন মানুষের স্বভাবজাত গুণানুসারে নির্ধারিত হয়েছে:

  • ব্রাহ্মণ: সত্ত্বগুণপ্রধান, যার কর্ম হলো শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সাত্ত্বিকী শ্রদ্ধা [১৮.৪১-৪২]।
  • ক্ষত্রিয়: সত্ত্ব-মিশ্রিত রজোগুণপ্রধান, যার কর্ম হলো পরাক্রম, তেজ, ধৈর্য, কার্যকুশলতা, যুদ্ধে অপরাঙ্মুখতা [১৮.৪৩]।

  • বৈশ্য: তমঃ-মিশ্রিত রজোগুণের আধিক্য, যার কর্ম হলো কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য [১৮.৪৪]।

  • শূদ্র: রজঃ-মিশ্রিত তমোগুণের আধিক্য, যার কর্ম হলো কেবল পরিচর্যাত্মক সেবা [১৮.৪৪]।

​আধুনিক ব্যাখ্যাকারীরা প্রায়শই উল্লেখ করেন যে, এই গুণ-কর্মভিত্তিক ব্যবস্থা একটি আদর্শ সামাজিক সংগঠনের রূপ, যার মূল বিকৃতি ঘটে তখনই, যখন এটি জন্মগত অধিকার দ্বারা নির্ধারিত হতে শুরু করে। জনপ্রিয় উক্তি অনুযায়ী, "birthright made the right wrong" ।

​তবে, দার্শনিক উদ্দেশ্য ছাড়াও গীতার একটি দ্বিমুখী সামাজিক ব্যবহার ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, গীতা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে রচিত হয়েছিল । এই সময়ে বৌদ্ধ, জৈন ও লোকায়ত দর্শন ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, কিছু বুদ্ধিমান মানুষ কৃষ্ণের উপদেশ ব্যবহার করে দার্শনিক মতবাদগুলিকে সমন্বিত করে এবং সেই সঙ্গে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রেণীগত মতাদর্শ জনগণের মানসিকতায় তুলে ধরার প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন । এই বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, যদিও গীতার মূল দর্শনে বর্ণ প্রথার পরিবর্তনশীলতার বীজ নিহিত ছিল, এর ঐতিহাসিক প্রয়োগ এবং রক্ষণশীল ব্যাখ্যাগুলি উচ্চ বর্ণের শ্রেণীগত আধিপত্য বজায় রাখার জন্য একটি শক্তিশালী কর্তৃত্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

​৩.০। বর্ণাশ্রম থেকে জাতিপ্রথার জন্ম: স্মৃতির বিধান ও সামাজিক ক্রমবিবর্তন

​বৈদিক যুগে নমনীয় ধারণা থাকার পরও, বর্ণ প্রথার কঠোরতা বৃদ্ধি পায় স্মৃতি সাহিত্য, বিশেষত মনুসংহিতার মাধ্যমে।

​৩.১। মনুসংহিতা ও জন্মভিত্তিক আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা

​মনুসংহিতা (Manusmriti) গুণভিত্তিক আদর্শকে কঠোর জন্মভিত্তিক, স্থিতিশীল কাঠামোতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংহিতা ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বকে সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করে। মনুসংহিতায় স্পষ্টত বলা হয়েছে যে, একমাত্র ব্রাহ্মণই সকল বর্ণের শাস্ত্রসম্মত জীবিকার উপায় জানবেন এবং সকলকে উপদেশ দেবেন । ব্রাহ্মণগণকে ব্রহ্মার মুখ থেকে উদ্ভূত এবং বেদকে অবলম্বন করার কারণে এই সৃষ্ট জগতের প্রভু বলে ঘোষণা করা হয় । এমনকি রাজারও প্রতিদিন প্রত্যুষে বয়োবৃদ্ধ ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করা এবং তাদের আদেশ প্রতিপালন করা কর্তব্য বলে বিধান দেওয়া হয়েছে । এই বিধানগুলি ব্রাহ্মণদের আধিপত্যকে কেবল ধর্মীয়ভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবেও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল।

​মনুসংহিতার রক্ষণশীল ভাষ্যকারগণ, যেমন কুল্লুক ভট্ট, এই আধিপত্যকে আরও দৃঢ় করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, চারটি বর্ণের মধ্যে উপরের তিনটি বর্ণ 'দ্বিজাতি' (দুইবার জন্ম), কারণ কেবল তাদেরই উপনয়ন-সংস্কারের অধিকার আছে। শূদ্ররা 'একজাতি' (একবার জন্ম) হওয়ায় তাদের উপনয়নের অধিকার নেই, ফলে তারা নিম্নবর্ণীয় দাস হিসেবে গণ্য। একইভাবে কুল্লুক ভট্টের ব্যাখ্যানুসারে, নারীও দ্বিজ হবার অধিকার না পাওয়ায় শূদ্রসমতুল্য বা শূদ্রই । মনুসংহিতা শূদ্রদের একমাত্র কর্তব্য হিসেবে উচ্চ তিন বর্ণের সেবা নির্দিষ্ট করে এবং তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অংশগ্রহণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে ।

​এই বিচার দেখায় যে, মনুসংহিতার বিধান এবং কুল্লুক ভট্টের মতো ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যাগুলি ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক কর্তৃত্বকে আইনগত বৈধতা (Legalization of Brahmanical Hegemony) দেয়। এর ফলে গুণভিত্তিক Varna-এর নমনীয়তা বিলুপ্ত হয়ে জন্মভিত্তিক Jati-এর কঠোরতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।

​৩.২। জাতি প্রথার ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক বিবর্তন

​জাতি প্রথা (Jati system) বর্ণ প্রথার সেই কঠোরতার বিস্তারিত ও জটিল সামাজিক প্রকাশ। বর্ণ ব্যবস্থায় একটি মোটা দাগের শ্রমবিভাগ প্রতিভাত ছিল, কিন্তু জাতি প্রথায় সেই শ্রমবিভাগের ভিত্তিতেই হাজার হাজার উপ-জাতি তৈরি হয়, যা ছিল পেশাগত স্বাতন্ত্র্য এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি ।

​জাতি প্রথার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল:

​1.  বংশানুক্রমিকতা: জন্মই সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করত, গুণগত যোগ্যতা বা কর্মের দ্বারা জাতির পরিবর্তন সম্ভব ছিল না ।

2.  অন্তর্বিবাহ গোষ্ঠী: স্বজাতির বাইরে বিবাহ সাধারণত নিষিদ্ধ ছিল ।

3.  বৃত্তিবিভাগ: প্রত্যেক জাতির একটি নির্দিষ্ট পেশা ছিল, যা বংশপরম্পরায় অনুসরণ করা হতো (যেমন ব্রাহ্মণের পূজা-অর্চনা, কুমোরের মাটির কাজ) ।

​ইতিহাসে দেখা যায়, জাতি প্রথা উৎপাদন ও বণ্টনের একটি অ-প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যা সমাজের প্রয়োজন মেটানো এবং ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করত । ফলস্বরূপ, প্রাত্যহিক সামাজিক জীবনে বর্ণ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং জাতি-প্রথার ভিত্তিতে হিন্দু সমাজের কাঠামো গড়ে ওঠে । বাংলার মতো অঞ্চলে যেখানে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য শ্রেণি ছিল না, সেখানে ব্রাহ্মণগণও জাতি হিসেবে পরিগণিত হতেন ।

​৪.০। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাকার ও দার্শনিক বিতর্ক: ভক্তি আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ

​শাস্ত্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন মতবাদ ও আন্দোলন প্রতিবাদ জানিয়েছে।

​৪.১। আদি শঙ্করাচার্যের অবস্থান

​অষ্টম শতাব্দীর দার্শনিক আদি শঙ্করাচার্য (যিনি শৈব সংস্কারবাদী ছিলেন) তাঁর গীতা ভাষ্যের মাধ্যমে ধর্মগ্রন্থটিকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করেন । তিনি কর্মফল ও পুনর্জন্মের দর্শনকে সমর্থন করেন, যা পরোক্ষভাবে বর্ণাশ্রম ধারণাকে সমাজে স্থিতিশীলতা দিতে সাহায্য করে। যদিও তাঁর দর্শন অদ্বৈত বেদান্তের উপর জোর দেয়, তাঁর প্রভাব গীতার গ্রহণযোগ্যতাকে এমন স্তরে নিয়ে যায়, যা শ্রেণীগত মতাদর্শ প্রসারে পরোক্ষভাবে সহায়ক হয়েছিল।

​৪.২। ভক্তি আন্দোলনের বিপ্লব (The Bhakti Revolution)

​মধ্যযুগে বর্ণ প্রথা ও জটিল আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া এসেছিল ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে । দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণব ও শৈব সাধকদের মাধ্যমে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ।

​ভক্তি সাধকদের মূল শিক্ষা ছিল সাম্য ও ব্যক্তিগত ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ। তাঁরা ঘোষণা করেন যে, ঈশ্বর ব্যক্তিগত এবং তাঁকে লাভ করার জন্য জাতি, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থানের কোনো বাধা নেই । ভক্তি দর্শন জটিল আচার-অনুষ্ঠান, বৈদিক মন্ত্র পাঠ এবং পুরোহিতের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করে মোক্ষ লাভের জন্য প্রেমময় ভক্তিকে একমাত্র পথ হিসেবে গ্রহণ করে ।

​ভক্তি সাধকরা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বৈষ্ণবদের একটি তীব্র মত ছিল: "বৈষ্ণব দেখিয়া যেবা জাতি বুদ্ধি করে তাহার সমান পাপী নাহিক সংসারে" । ভক্তি আন্দোলন ছিল আধ্যাত্মিক পথের গণতান্ত্রিকীকরণ (Democratization of the Spiritual Path), কারণ এটি উচ্চ বর্ণের জন্য সংরক্ষিত দ্বিজত্বের অধিকার বা কঠিন শাস্ত্রীয় রীতিনীতি এড়িয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে সরাসরি আধ্যাত্মিক মুক্তির অধিকার এনে দেয়। এই আন্দোলন ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিল।




​৫.০। আধুনিক পণ্ডিত ও সংস্কারকদের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

​উনিশ ও বিশ শতকে বর্ণ প্রথা ভারতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে আসে। ড. বি. আর. আম্বেদকর ও স্বামী বিবেকানন্দের মতো ব্যক্তিত্ব এই কাঠামোর উপর কাঠামোগত প্রশ্ন উত্থাপন করেন।

​৫.১। ড. বি. আর. আম্বেদকর: বর্ণ ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও আইনি সংগ্রাম

​ড. বি. আর. আম্বেদকর ছিলেন জাতি প্রথার কঠোরতম সমালোচকদের মধ্যে একজন। তিনি হিন্দু সমাজের আমূল পরিবর্তন এবং জাতি প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি (Annihilation of Caste) চেয়েছিলেন। তাঁর সংগ্রাম প্রমাণ করে যে, সামাজিক প্রথার বিলুপ্তি কেবল ধর্মীয় বা দার্শনিক আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব নয়, এর জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং কঠোর আইনি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

​১৯৫০-এর দশকে যখন আইন মন্ত্রী হিসেবে আম্বেদকর হিন্দু কোড বিল লোকসভায় পেশ করেন, তখন দেশজুড়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয় । তিনি শাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বিধিতে নারীর সম্পত্তি উত্তরাধিকারের মতো (দায়ভাগ ও পিতৃসবর্ণ স্মৃতির উপর ভিত্তি করে) পুরনো নীতিগুলিই পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে, কোনো নতুন বিধান আনা হয়নি । রক্ষণশীল হিন্দুদের প্রবল বিরোধিতার মুখে বিলটি পাস না হওয়ায়, তিনি অতৃপ্তির কারণে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন । তাঁর রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেখিয়েছিল যে, জাতিভেদ প্রথা কেবল একটি সামাজিক অভ্যাস নয়, বরং এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের রক্ষক।

​৫.২। স্বামী বিবেকানন্দ: আদর্শ সমাজের কল্পনা ও শূদ্র যুগের অনিবার্যতা

​স্বামী বিবেকানন্দ জন্মভিত্তিক সঙ্কীর্ণতার বিরোধী ছিলেন এবং বর্ণসঙ্করা (Varnasankara) ধারণাকে কেবল জন্মভিত্তিক প্রথার ক্ষেত্রেই অর্থবহ বলে মনে করতেন ।

​বিবেকানন্দ সমাজ বিবর্তনের একটি চক্রাকার তত্ত্ব পেশ করেন, যেখানে সমাজ ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ (পুরোহিত), ক্ষত্রিয় (সৈনিক) ও বৈশ্য (ব্যবসায়ী) দ্বারা শাসিত হওয়ার পর অনিবার্যভাবে শূদ্র (মজুর বা সর্বহারা) শাসনের দিকে অগ্রসর হয় । তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, শূদ্র যুগে গরীবরা তাদের অসমান জীবন সংগ্রাম থেকে অনেকটাই সুবিধা পাবে, কিন্তু এই শূদ্র শাসনকেও তিনি সর্বোচ্চ বা আদর্শ শাসন ব্যবস্থা মনে করেননি ।

​তাঁর মতে, শোষণহীন একটি আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য সকল বর্ণের শ্রেষ্ঠ গুণের সমন্বয় প্রয়োজন: "ব্রাহ্মণ যুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয় সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ এই সব গুলি ঠিক ঠিক বজায় থাকবে, অথচ এদের দোষ গুলি থাকবে না" । তিনি মনে করতেন, সমাজের সকলেরই ব্রাহ্মণ হওয়া উচিত, কিন্তু এই 'ব্রাহ্মণ' শব্দটি ব্রহ্মজ্ঞানী বা ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য সচেষ্ট ব্যক্তি অর্থেই ব্যবহৃত । বিবেকানন্দের এই আহ্বান এবং শূদ্র যুগের অনিবার্যতা ঘোষণার মধ্যে সামাজিক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেখা যায়, যা আধুনিক সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

​৫.৩। মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য আধুনিক মতাদর্শ

​মহাত্মা গান্ধী বর্ণ ব্যবস্থার সংস্কার চাইলেও ধর্ম পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন । তিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়েছেন।

​সমাজবিজ্ঞানী লুই ডুমোঁ (Louis Dumont) জাতিপ্রথাকে ধর্মীয় পবিত্রতা-অপবিত্রতার ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে ব্যাখ্যা করেন । তবে আন্দ্র বেটেইল (André Beteille) এর মতো আধুনিক পণ্ডিতরা লক্ষ করেন যে শাস্ত্রীয় সাহিত্যে বর্ণ প্রাধান্য পেলেও বর্তমান সমাজে জাতি (Jati) প্রথা মুখ্য ভূমিকা পালন করে, যা জন্মভিত্তিক, অন্তঃবিবাহ গোষ্ঠী এবং পেশা দ্বারা নির্ধারিত ।

​৬.০। সমাজে প্রচলিত ভয়াবহ মিথ ও মুক্তির পথ

​বর্ণ প্রথাকে ঘিরে সমাজে এক শক্তিশালী ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে আছে, যা বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখে। এই মিথটি মূলত ঐশ্বরিক অনুমোদন এবং কর্মফলের মতো ধারণার উপর নির্ভরশীল।

​৬.১। মিথের স্বরূপ: ঐশ্বরিক অনুমোদন ও সিস্টেম জাস্টিফিকেশন

​সবচেয়ে ভয়াবহ মিথটি হলো, বর্ণভিত্তিক বৈষম্যকে ঐশ্বরিক বা প্রাকৃতিক (যেমন কর্মফল বা ধর্মীয় ম্যান্ডেট) বলে বিশ্বাস করা, যা নিপীড়ন ও অসমতাকে ন্যায্য বলে প্রমাণ করে ।

​মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সিস্টেম জাস্টিফিকেশন থিওরি দেখায় যে, মানুষ কখনও কখনও অচেতনভাবে নিপীড়ক সামাজিক ব্যবস্থাগুলিকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি মানসিক কাঠামো তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় নিম্ন বর্ণের মানুষজনও তাদের নিজস্ব নীচু অবস্থানকে গ্রহণ করে নেয়, কারণ এই ব্যবস্থাটি দীর্ঘকাল ধরে বৈধতা পেয়ে আসছে । এই ধর্মীয় মিথটি (যেমন, 'তোমার পূর্বজন্মের কর্মফলই তোমাকে এই জন্মে শূদ্র করেছে') নিম্ন বর্ণের মানুষকে বৈষম্য মেনে নিতে উৎসাহিত করে, যা সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ঢাল (Psychological Shield) হিসেবে কাজ করে।

​বাস্তবে দেখা যায়, জাতিভিত্তিক বৈষম্য কেবল সামাজিক মর্যাদার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বস্তুগত বৈষম্য তৈরি করে। নিম্ন বর্ণের মানুষেরা উৎপাদনশীল সম্পদের অসম প্রবেশাধিকার এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। এমনকি উচ্চশিক্ষিত নিম্ন বর্ণের সদস্যরাও সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের সম্মুখীন হন । বিভিন্ন সূচকে এখনও ব্রাহ্মণদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণে আধিপত্য দেখা যায় ।

​৬.২। মিথ থেকে পরিত্রাণ: জ্ঞানগত পুনর্বিচার ও সমষ্টিগত শিক্ষা

​এই ভয়াবহ মিথ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন জ্ঞানগত পুনর্বিচার ও সমাজের সমষ্টিগত শিক্ষা।

​১. আখ্যানের পুনর্লিখন: শত শত বছর ধরে এই প্রথাকে বৈধতা দেওয়া আখ্যানগুলিকে পুনর্লিখন করতে হবে। বর্ণপ্রথাকে একটি ঐশ্বরিক ম্যান্ডেট হিসাবে নয়, বরং উচ্চ বর্ণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সামাজিক নির্মাণ (Social Construct) হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন ।

২. সমষ্টিগত শিক্ষা: জনগণের মধ্যে অচেতন মানসিক কাঠামোটিকে শনাক্ত করে প্রত্যাখ্যানের জন্য সমষ্টিগত শিক্ষা আবশ্যক। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তিরা সেই মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোটি বর্জন না করবে, যা জাতিগত পদবিগুলিকে ধরে রাখে, ততক্ষণ প্রকৃত সমতা অধরা থাকবে ।

৩. কাঠামোগত পরিবর্তন: এই মিথের ফলে সৃষ্ট বস্তুগত বৈষম্য (Material Disadvantage) দূর করার জন্য অর্থনৈতিক ও আইনি স্তরে হস্তক্ষেপ জরুরি। উৎপাদনশীল সম্পদের অসম প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্যমূলক ফলাফলের বিরুদ্ধে সুচিন্তিত জননীতিগত লড়াই প্রয়োজন ।

​৬.৩। আইনি সংস্কারের সীমাবদ্ধতা

​ভারতের সংরক্ষণ নীতি (Reservations) ঐতিহাসিক বৈষম্য দূর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রচেষ্টা। তবে আইনি ব্যবস্থার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত টানাপোড়েন লক্ষ করা যায়। একদিকে সংবিধান সামাজিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, অন্যদিকে আদালত কখনও কখনও জাতি বা উপজাতির নিজস্ব সীমা নির্ধারণের কর্তৃত্বের প্রতি নমনীয়তা দেখায় । এই নমনীয়তা সাম্যের আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে এবং শ্রেণিগত কর্তৃত্বকে পুনরায় বৈধতা দিতে পারে। তাই জাতি প্রথা বিলুপ্তির প্রচেষ্টায় আইনি হস্তক্ষেপের পাশাপাশি মানসিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও অপরিহার্য।

​৭.০। উপসংহার ও সুপারিশ

​৭.১। বর্ণ প্রথার সারসংক্ষেপ

​হিন্দু ধর্মের বর্ণ প্রথা, যা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত, তা শাস্ত্রীয় আদর্শ (গুণ ও কর্মভিত্তিক Varna) থেকে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় (জন্মভিত্তিক, কঠোর Jati) বিকৃত হয়েছে। ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্তের প্রক্ষেপণ বিতর্ক এবং মনুসংহিতার কঠোর বিধান এই বিকৃতিকে জন্ম দিয়েছে। মনুসংহিতা এবং কুল্লুক ভট্টের মতো ভাষ্যকারগণ জন্মভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বকে শক্তিশালী করে ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্যযুগে ভক্তি আন্দোলন এবং আধুনিক কালে ড. বি. আর. আম্বেদকর ও স্বামী বিবেকানন্দের মতো সংস্কারকগণ এই সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম করেছেন। বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের মূলে রয়েছে একটি মিথ, যা বৈষম্যকে ঐশ্বরিক বা প্রাকৃতিক বলে ন্যায্যতা দেয়, যার ফলে সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় থাকে এবং বস্তুগত বৈষম্য স্থায়ী হয়।

​৭.২। মুক্তির পথ ও দিকনির্দেশ

​সমাজের মিথ এবং বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য একটি বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করা আবশ্যক:

​১. মনস্তাত্ত্বিক ও শিক্ষামূলক পুনর্বিচার: বর্ণ প্রথার উৎপত্তি ও বিবর্তনের প্রকৃত ইতিহাস পাঠক্রমের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে। কর্মফল ও ঐশ্বরিক ম্যান্ডেটের নামে প্রচারিত বৈষম্যের আখ্যানগুলিকে ঐতিহাসিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করা এবং সেগুলিকে সামাজিক নির্মাণ হিসেবে চিহ্নিত করা অপরিহার্য।

২. কাঠামোগত ন্যায়বিচার: ড. বি. আর. আম্বেদকরের পথ অনুসরণ করে কেবল সামাজিক মর্যাদা নয়, বরং উৎপাদনশীল সম্পদের অসম প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্যমূলক ফলাফলের (inequality of outcomes) বিরুদ্ধে জননীতিগত লড়াই প্রয়োজন।

৩. সমন্বয়ের আদর্শ: স্বামী বিবেকানন্দের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি আদর্শ সমাজ গঠনের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত, যেখানে ব্রাহ্মণ যুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয় সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি, এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ—সকলের শ্রেষ্ঠ দিকগুলির সমন্বয় ঘটবে এবং কোনো শোষণ বা বৈষম্য থাকবে না। এটিই সামাজিক গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ। 




Wednesday, 15 October 2025

"Lotus Beneath the Banyan: A Journey of Love, Loss, and Renewal"

 A Tale of Innocence and Heartbreak


Chandra was a simple and innocent soul, his heart as pure as the morning dew. He worked diligently in a manufacturing company, his days filled with the rhythmic hum of machines and the scent of freshly molded metal. Life was straightforward, until one fateful day when he stumbled upon Sima on Facebook.


Sima was a vision of beauty, her profile adorned with pictures that captured her radiant smile and sparkling eyes. Their initial conversations were light and breezy, but as days turned into weeks, their bond deepened. They shared dreams, fears, and secrets, weaving a tapestry of intimacy that enveloped them both. Their families, too, became aware of this blossoming relationship, giving their silent blessings.


Their first meeting in the historic city of Murshidabad was nothing short of magical. The ancient palaces and serene riverbanks bore witness to their burgeoning love. They walked hand in hand, their fingers intertwined like the roots of an ancient tree, drawing strength from each other. Their love was a river, flowing freely and passionately, carving its path through the landscape of their lives.


However, life, with its unpredictable twists, soon cast a shadow over their happiness. Chandra lost his job, and with it, his sense of stability. He knocked on many doors, attended countless interviews, but success eluded him. The weight of his failures pressed down on him, like a dark cloud obscuring the sun. Stress gnawed at his spirit, leaving him vulnerable and weary.


During this turbulent time, Sima's affections began to wane. Her heart, once a sanctuary for Chandra, started drifting towards another. She met a businessman, a man of means and ambition, and found herself drawn to his world of luxury and promise. Without a word to Chandra, she made the decision to marry this new suitor.


The news of Sima's marriage hit Chandra like a thunderbolt. He was blindsided, his world crumbling around him. Tears flowed freely, each drop a testament to his shattered dreams and broken heart. The vibrant colors of his life faded into a dull gray, and he sank into the depths of depression.


Chandra's Journey of Resilience


Chandra's world had collapsed, leaving him adrift in a sea of sorrow. The days blurred into nights, and the once vibrant spark in his eyes dimmed. But even in the darkest of times, a glimmer of hope can emerge.


One evening, as Chandra sat by the riverbank where he and Sima had once walked hand in hand, he noticed the gentle flow of the water. It reminded him of life's constant movement, never stagnant, always pushing forward. This realization sparked a small flame of determination within him.


Determined to rebuild his life, Chandra decided to focus on his passions. He had always been fascinated by the art of craftsmanship, a skill he had honed during his years in the manufacturing company. He began creating intricate wooden sculptures, pouring his heart and soul into each piece. His creations were a reflection of his journey—each curve and detail telling a story of resilience and hope.


Word of Chandra's talent spread through the village, and soon, his sculptures caught the eye of a local art gallery owner. Impressed by the raw emotion and skill in Chandra's work, the gallery owner offered him a chance to showcase his pieces. The exhibition was a success, and Chandra's sculptures were praised for their beauty and depth.


With newfound confidence, Chandra continued to create and explore new artistic avenues. He started teaching young aspiring artists, sharing his knowledge and experiences. Through his art, he found a way to heal and inspire others who had faced similar struggles.


One day, while attending an art fair, Chandra met a woman named Maya. She was an artist too, with a passion for painting. They bonded over their shared love for art and their stories of overcoming adversity. Maya's vibrant personality and unwavering support brought a new light into Chandra's life.


As they spent more time together, Chandra realized that love could be found again, even after heartbreak. Maya's presence was like a soothing balm to his wounded heart. Together, they created beautiful art and cherished the simple joys of life.


Chandra's journey from heartbreak to healing was a testament to the strength of the human spirit. He learned that even in the face of immense pain, one can find purpose and joy. His story became an inspiration to many, a reminder that life, with all its ups and downs, is a journey worth embracing.


Chandra's Artistic Renaissance


Chandra's journey into the world of art was just beginning. With Maya by his side, he felt a renewed sense of purpose and creativity. Together, they decided to explore different forms of art, pushing the boundaries of their imagination.


One day, Maya suggested they try their hands at mural painting. The idea excited Chandra, as it was something he had never attempted before. They approached the local community center and proposed a project to create a mural that would reflect the spirit and culture of their village. The community embraced the idea with enthusiasm, and soon, Chandra and Maya found themselves at the heart of a collaborative artistic endeavor.


The mural project brought together people from all walks of life. Children, elders, and fellow artists joined in, each contributing their unique touch to the mural. Chandra and Maya guided the process, ensuring that every brushstroke and color choice resonated with the collective vision. The mural depicted scenes of daily life, historical landmarks, and the natural beauty of their surroundings. It became a vibrant tapestry of their shared heritage and dreams.


As the mural took shape, Chandra felt a deep sense of fulfillment. The project not only beautified the community center but also strengthened the bonds among the villagers. It was a testament to the power of art to bring people together and create lasting memories.


Encouraged by the success of the mural, Chandra and Maya decided to take their art on the road. They traveled to nearby towns and cities, participating in art fairs and exhibitions. Each new place they visited added fresh inspiration to their work. They experimented with different mediums—sculpture, painting, and even digital art. Chandra's sculptures became more intricate, and Maya's paintings more expressive.


During one of their travels, they met a renowned art curator who was impressed by their work. He invited them to showcase their art in a prestigious gallery in Kolkata. The exhibition was a milestone in their artistic journey, attracting art enthusiasts and critics alike. Chandra's sculptures, with their intricate details and emotional depth, received high praise. Maya's vibrant paintings captivated the audience, each piece telling a story of resilience and hope.


The success of the exhibition opened new doors for Chandra and Maya. They were invited to conduct workshops and seminars, sharing their techniques and experiences with aspiring artists. Chandra found immense joy in teaching, guiding young talents to discover their own artistic voices. His journey from a simple, innocent boy to a celebrated artist was an inspiration to many.


Through their art, Chandra and Maya continued to explore the depths of human emotion and experience. They created pieces that spoke of love, loss, hope, and renewal. Their work became a mirror reflecting the beauty and complexity of life.


Chandra and Maya's Artistic Odyssey


Chandra and Maya's journey continued to unfold like a beautiful, ever-changing canvas. Their travels took them to diverse landscapes, each offering new inspiration and challenges. They embraced every opportunity to learn and grow, their art evolving with each new experience.


Their next destination was the serene hills of Darjeeling. The misty mornings and lush tea gardens provided a tranquil backdrop for their creativity. Chandra found himself captivated by the intricate patterns of the tea leaves and the play of light and shadow on the hills. He began sculpting a series of pieces that captured the essence of the landscape, each sculpture a tribute to the natural beauty that surrounded them.


Maya, on the other hand, was drawn to the vibrant culture of the local people. She spent hours painting scenes of daily life, from the bustling markets to the quiet moments of reflection by the hillside monasteries. Her paintings were a celebration of the rich tapestry of life in Darjeeling, each brushstroke infused with the warmth and spirit of the people she met.


Their journey then took them to the bustling city of Varanasi, a place where history and spirituality intertwined. The ghats of the Ganges River, with their ancient rituals and timeless beauty, became a source of profound inspiration. Chandra and Maya spent days sketching and painting by the river, capturing the essence of the city's soul.


Chandra's sculptures from Varanasi were imbued with a sense of spirituality and reverence. He created pieces that depicted the sacred rituals and the serene expressions of the devotees. Each sculpture was a testament to the deep connection between the physical and the spiritual, a reflection of the city's enduring legacy.


Maya's paintings from Varanasi were equally evocative. She captured the vibrant colors of the festivals, the intricate designs of the temples, and the quiet moments of prayer and meditation. Her work resonated with the energy and spirituality of the city, each piece telling a story of devotion and faith.


Their travels also took them to the coastal town of Puri, where the vast expanse of the sea and the rhythmic sound of the waves provided a new source of inspiration. Chandra and Maya spent hours by the beach, their creativity flowing like the tides. Chandra's sculptures from Puri were fluid and dynamic, capturing the movement and power of the ocean. Maya's paintings were filled with the vibrant hues of the sunset, the golden sands, and the azure waters.


Throughout their journey, Chandra and Maya continued to learn from each other and from the world around them. They attended workshops, collaborated with local artists, and participated in art festivals. Each new experience added depth and richness to their work, pushing the boundaries of their creativity.


Their artistic discoveries were not just about creating beautiful pieces but also about understanding the world and their place in it. They learned to see the beauty in the mundane, to find inspiration in the everyday moments, and to appreciate the diversity of human experience.


Chandra and Maya's Encounter with the Mysterious Artist


As Chandra and Maya continued their artistic journey, they found themselves in the enchanting town of Udaipur, known for its majestic palaces and serene lakes. The city, with its rich history and vibrant culture, was a treasure trove of inspiration. They decided to stay for a while, immersing themselves in the local art scene and exploring the hidden corners of the city.


One evening, while wandering through the narrow, winding streets of the old city, they stumbled upon a small, dimly lit art gallery. The sign above the door read "Mystique Art Studio." Intrigued by the name, they decided to step inside.


The gallery was unlike any they had seen before. The walls were adorned with paintings that seemed to come alive with emotion and mystery. Each piece told a story, drawing the viewer into a world of imagination and wonder. At the center of the gallery stood a tall, slender figure, his face partially hidden by a wide-brimmed hat. He was the mysterious artist behind these captivating works.


The artist introduced himself as Arav, a name that seemed to carry an air of enigma. His eyes sparkled with a depth of knowledge and experience that hinted at a life filled with adventure and discovery. Arav welcomed Chandra and Maya warmly, inviting them to explore his world of art.


As they conversed, Arav shared stories of his travels to distant lands and his encounters with different cultures. He spoke of the inspiration he drew from the people he met and the places he visited. His art was a reflection of his journey, each piece a fragment of his soul.


Chandra and Maya were mesmerized by Arav's tales and his unique perspective on art. They spent hours discussing techniques, philosophies, and the essence of creativity. Arav's wisdom and passion reignited their own creative spirits, pushing them to explore new dimensions in their work.


Arav invited them to join him in a collaborative project—a mural that would capture the essence of Udaipur. Together, they worked tirelessly, blending their styles and ideas to create a masterpiece that celebrated the city's beauty and spirit. The mural became a symbol of their shared journey and the bond they had formed with Arav.


Through their collaboration, Chandra and Maya learned to see the world through new eyes. Arav's mysterious aura and profound insights left a lasting impression on them. He taught them that art was not just about creating beautiful pieces but about capturing the essence of life and the human experience.


Their encounter with Arav was a turning point in their journey. It deepened their understanding of art and its power to connect people across time and space. As they bid farewell to Udaipur, they carried with them the lessons and inspiration they had gained from the mysterious artist.


Chandra and Maya's Romantic Nights


After their enriching journey to Udaipur, Chandra and Maya returned home, their hearts brimming with inspiration and their minds filled with new ideas. The house was unusually quiet, as Chandra's family had gone on a pilgrimage, leaving the couple to enjoy some precious time alone.


The first night back, the air was cool and fragrant with the scent of blooming jasmine. Chandra and Maya decided to spend the evening on the terrace, under the canopy of stars. They spread out a soft blanket and lay side by side, gazing up at the night sky. The stars seemed to twinkle just for them, creating a magical atmosphere.


Chandra gently took Maya's hand in his, their fingers intertwining naturally. "Do you remember the first time we met?" he asked, his voice soft and filled with affection.


Maya smiled, her eyes reflecting the starlight. "How could I forget? It feels like it was just yesterday, yet we've come so far together."


They reminisced about their journey, the places they had visited, and the people they had met. Each memory was a thread that wove their hearts closer together. As they talked, Chandra leaned in and kissed Maya gently, their lips meeting in a tender embrace. The world around them seemed to fade away, leaving only the warmth of their love.


Later, they moved inside to the cozy living room. Chandra lit a few candles, their soft glow casting a warm light across the room. Maya put on some soothing music, and they danced slowly, swaying to the rhythm. The intimacy of the moment was palpable, each movement a silent declaration of their love.


As the night grew deeper, they settled on the couch, wrapped in each other's arms. Chandra whispered sweet nothings into Maya's ear, making her giggle softly. They talked about their dreams for the future, the art they wanted to create, and the life they envisioned together.


The next night, they decided to cook a special dinner together. The kitchen was filled with laughter and the delicious aroma of spices. They worked side by side, creating a meal that was as much a feast for the senses as it was for the soul. Over dinner, they toasted to their love and the adventures that lay ahead.


After dinner, they retreated to the bedroom, where Chandra had set up a surprise. He had scattered rose petals across the bed and lit more candles, creating a romantic haven. Maya was touched by the gesture, her eyes welling up with tears of joy. They spent the night wrapped in each other's embrace, their love a comforting cocoon.


A Morning in Gangrali


The next morning, Chandra and Maya decided to explore the nearby vast paddy fields, a place where nature's beauty and mystery intertwined. The fields stretched out like a green ocean, the paddy swaying gently in the breeze, whispering secrets of the earth. Among these fields lay several ponds, each with its own story, but none as enchanting and eerie as Gangrali.


Gangrali was a place of paradoxes, both lovely and terrifying. It was surrounded by a majestic, ancient banyan tree, its roots sprawling like the fingers of time, reaching deep into the earth. The tree stood as a silent guardian, its branches providing a canopy of shade and mystery. Beneath its boughs lay a cremation pier, a stark reminder of life's impermanence, adding an air of solemnity to the serene surroundings.


Beside the pier was the pond of Gangrali, where countless lotuses bloomed, their delicate petals floating like whispers of beauty on the water's surface. The pond was a mirror, reflecting the sky and the surrounding greenery, creating a scene of ethereal tranquility. The lotuses, with their pristine beauty, seemed to dance on the water, their reflections shimmering like dreams.


As Chandra and Maya walked the two miles from their home to Gangrali, the morning sun cast a golden glow over the fields, turning the dew-kissed paddy into a sea of emeralds. The air was filled with the sweet scent of blooming flowers and the distant calls of birds, creating a symphony of nature.


Maya, unfamiliar with Gangrali, was captivated by its beauty and the stories Chandra shared. He spoke of the banyan tree's age-old legends, the spirits believed to reside there, and the rituals performed at the cremation pier. Maya listened with wide-eyed wonder, her imagination painting vivid pictures of the tales.


Standing by the pond, they marveled at the sight of the blooming lotuses. "It's like a scene from a fairy tale," Maya whispered, her voice filled with awe. Chandra nodded, his heart swelling with pride and love for the place he called home.


The vast fields of green paddy surrounded Gangrali like a protective embrace, their vibrant color a testament to the land's fertility and life. The sight was awe-inspiring, a reminder of nature's boundless beauty and the simple joys it offered.


Chandra's Parents Return from Pilgrimage


The sun had just begun its descent, casting a golden hue over the village, when Chandra's parents returned from their pilgrimage. Their faces were radiant with the glow of spiritual fulfillment, and their hearts were brimming with tales of divine encounters and sacred places. The air was filled with a sense of reverence and joy as they stepped into their home, bringing with them the blessings of the holy sites they had visited.


Chandra and Maya welcomed them with open arms, eager to hear about their journey. The evening was spent in the cozy warmth of their living room, where Chandra's parents recounted their experiences. Each story was a vivid tapestry of devotion, woven with threads of faith and wonder.


Exploration of Sacred Places


Their pilgrimage had taken them to some of the most revered places in India. They spoke of the majestic temples of Varanasi, where the Ganges flowed like a river of time, carrying with it the prayers and hopes of countless devotees. The ghats, with their ancient steps leading down to the sacred waters, were alive with the chants of priests and the fragrance of incense. It was as if the very air was imbued with the essence of divinity.


In Rishikesh, they had felt the serenity of the Himalayas, the towering peaks standing as silent sentinels of eternity. The cool, crisp air was filled with the sound of the Ganges rushing over rocks, a symphony of nature that echoed the eternal flow of life. They had meditated in the ashrams, finding peace in the stillness and connecting with the deeper currents of their souls.


Their journey also took them to the golden sands of Puri, where the Jagannath Temple stood in all its glory. The temple, with its towering spires and intricate carvings, was a testament to the devotion of generations. The sea breeze carried the sound of the conch shells and the rhythmic beating of drums, creating a divine orchestra that resonated with their hearts. 


A New Chapter: Maya's Pregnancy


The news of Maya's pregnancy brought a wave of joy and excitement into Chandra's life. It was as if a new dawn had broken, filling their world with light and hope. The couple embraced this new chapter with open hearts, ready to embark on the journey of parenthood together.


As the days passed, Maya's pregnancy became a beautiful symphony of changes and emotions. Her face glowed with an inner radiance, and Chandra couldn't help but marvel at the miracle of life growing within her. They spent countless hours talking about their dreams for their child, imagining the future with a sense of wonder and anticipation.


One serene morning, Chandra and Maya decided to revisit Gangrali, the place that held so many memories for them. The journey to the paddy fields felt different this time, imbued with a deeper sense of purpose and connection. The fields, with their lush green expanse, seemed to welcome them with open arms, whispering promises of new beginnings.


As they walked hand in hand, Chandra gently placed his hand on Maya's growing belly, feeling the life within. "Our little one will love this place," he said softly, his voice filled with love and pride. Maya smiled, her eyes reflecting the same sentiment. "Yes, this will be a place of many stories and adventures for our child."


When they reached Gangrali, the sight of the blooming lotuses and the ancient banyan tree took on a new significance. The pond, with its serene waters and delicate flowers, seemed to symbolize the purity and beauty of new life. They sat by the water's edge, soaking in the tranquility and the promise of the future.


Maya closed her eyes and took a deep breath, feeling the gentle breeze caress her face. "I can feel the energy of this place," she whispered. "It's as if nature itself is blessing our child." Chandra nodded, his heart swelling with gratitude and love for Maya and their unborn baby.


The vast fields of paddy, swaying gently in the breeze, seemed to dance in celebration of their joy. The sun cast a golden glow over the landscape, turning the green fields into a shimmering sea of light. It was a moment of pure magic, a memory they would cherish forever.


As they made their way back home, Chandra and Maya talked about the future, their hopes and dreams for their child. They imagined the laughter and joy that would fill their home, the adventures they would share, and the love that would bind them together as a family.


A Happy Ending: The Bloom of New Beginnings


The seasons turned gently, like pages in a well-loved book, and Chandra and Maya’s life blossomed into a quiet symphony of joy. The news of Maya’s pregnancy had rippled through the family like sunlight on water—soft, golden, and full of promise. Chandra’s parents, returned from their pilgrimage with hearts full of blessings, embraced the coming child as a divine gift, a continuation of their lineage and love.


Their home, once echoing with silence, now pulsed with anticipation. Maya’s laughter filled the rooms like birdsong at dawn, and Chandra’s sculptures took on new forms—rounded, tender, full of life. He carved a cradle from sandalwood, its curves echoing the lotus petals of Gangrali, where they had once sat dreaming of the future.


One radiant morning, under the same banyan tree that had once whispered mysteries to them, Chandra and Maya held a small ceremony. The pond of Gangrali shimmered with blooming lotuses, as if nature itself had come to bless their union and the life they had created. The paddy fields swayed in rhythm, a green ocean applauding their journey.


When their child was born—a daughter with eyes like twilight and a cry like a flute’s first note—the village rejoiced. She was named Sharanya, meaning protector and refuge, for she had arrived as a balm to every wound, a promise of continuity and grace.


Chandra’s art flourished. His sculptures traveled to galleries far and wide, but he always returned to the soil of his village, to the banyan’s shade, to the pond’s reflection. Maya began painting again, her canvases filled with motherly warmth and mythic tenderness. Together, they taught art to children, turning their home into a sanctuary of creativity.


And in the evenings, when the stars blinked like ancestral eyes, the family would gather on the terrace. Chandra would tell Sharanya stories—of love and loss, of lotus ponds and mysterious artists, of resilience and rebirth. Maya would hum lullabies, her voice weaving dreams into the night.


Their story, once marked by heartbreak, had become a tapestry of healing. The past was not forgotten—it was honored, transformed, and woven into the present. In the dance of shadows and light, they had found their rhythm.


And so, beneath the banyan’s eternal gaze and the lotus’s quiet bloom, Chandra and Maya lived a life of meaning, art, and love—proof that even the simplest souls can carve beauty from sorrow and build joy from the ruins of grief.


The end was not an end at all. It was a beginning, wrapped in laughter, lotus petals, and the heartbeat of a child. 🌸




Friday, 3 October 2025

Law of Attraction


**আমার কর্মের বিশ্বাস**

*(লেখকের "আমি বিশ্বাস করি")*


আমি বিশ্বাস করি মানুষের মন ধারণ করে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি—

যে চিন্তা শক্তির এক মহত্তম প্রকাশ।

আমি বিশ্বাস করি যে মানুষ চিন্তাশক্তির ব্যবহার জানে,

সে নিজেকে প্রায় যা ইচ্ছা তাই রূপে গড়তে পারে।

আমি বিশ্বাস করি শুধু দেহ নয়, মন দ্বারা পরিবেশ, "ভাগ্য", পরিস্থিতিও পরিবর্তন করা যায়,

ইতিবাচক চিন্তা নেতিবাচক চিন্তার স্থান নিলে। আমি জানি "আমি পারি এবং আমি করব" মনোভাব

কাউকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে যা "আমি পারি না" স্তরের মানুষের কাছে অলৌকিক মনে হবে।

আমি বিশ্বাস করি "চিন্তা জিনিস", এবং চিন্তার জগতে আকর্ষণের নিয়ম ঠিক তাই টেনে আনবে যা একজন কামনা করে বা ভয় পায়।

আমি কর্মের সুসমাচারে বিশ্বাস করি—"দ্রুত কর্মে"। আমি "আমি হই"-এর সাথে "আমি করি"-তেও বিশ্বাস করি।

আমি জানি যে ব্যক্তি মনের শক্তির সুবিধা গ্রহণ করবে, এবং সেই শক্তিকে কর্মে প্রকাশ করবে,

সে সাফল্যের দিকে তেমনই নিশ্চিত ও অবিচলভাবে এগিয়ে যাবে যেমন দক্ষ তীরন্দাজের ধনুক থেকে তীর।

আমি মানব ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করি।

আমি দয়ালু হতে বিশ্বাস করি।

আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেকের নিজের কাজে মন দেওয়া উচিত—এবং অন্য সবাইকেও সেই অধিকার দেওয়া উচিত।

আমি বিশ্বাস করি আমাদের নিন্দা করার অধিকার নেই—"যে নিষ্পাপ, সে প্রথম পাথর ছুঁড়ুক।"

আমি বিশ্বাস করি যে ঘৃণা করে সে হত্যাকারী; যে লোভ করে সে চোর;

যে লালসা করে সে ব্যভিচারী; একটি অপরাধের সারমর্ম তার কামনার মধ্যেই নিহিত।

এই দেখে—আমাদের নিজেদের হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে—আমরা কীভাবে নিন্দা করতে পারি?

আমি বিশ্বাস করি যে মন্দ আর কিছুই নয়, কেবল অজ্ঞতা।


**আমার বিশ্বাস**


আমি বিশ্বাস করি "সবকিছু জানা মানে সবকিছু ক্ষমা করা।"

আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষের মধ্যে ভালো কিছু আছে; আসুন, আমরা তাকে তা প্রকাশ করতে সাহায্য করি।

আমি নর ও নারীর পরম সমতায় বিশ্বাস করি—মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যেন নারীর পক্ষেই পাল্লাটা একটু বেশি ভারী।

আমি যৌনতার পবিত্রতায় বিশ্বাস করি—তবে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে যৌনতা আধ্যাত্মিক ও মানসিক স্তরেও তেমনই প্রকাশিত হয় যেমন ভৌত স্তরে। আর আমি বিশ্বাস করি শুদ্ধের কাছে সবকিছুই শুদ্ধ।

আমি বিশ্বাস করি মানুষ অমর—সেই আসল সত্তা আত্মা, যা মন ও শরীরকে তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সেই হাতিয়ারের যোগ্যতার অনুসারে নিজেকে প্রকাশ করে।

আমি বিশ্বাস করি মানুষ দ্রুত চেতনার এক নতুন স্তরে উন্নীত হচ্ছে, যেখানে সে নিজেকে যেমন সে তেমনই জানতে পারবে—"আমি আছি"—অন্তরের সেই 'কিছু'কে চিনতে পারবে।

আমি বিশ্বাস করি সকল কিছুর মধ্যে এবং সকলের ঊর্ধ্বে এক অনন্ত শক্তি বিরাজমান।

আমি বিশ্বাস করি, যদিও আজ আমরা সেই শক্তির অতি সামান্য ধারণাই রাখি, তবুও আমরা ধীরে ধীরে তা আরও সম্পূর্ণরূপে বুঝতে সক্ষম হব—তার আরও কাছাকাছি পৌঁছাব। এমনকি এখনই আমরা ক্ষণিকের জন্য তার অস্তিত্বের ঝলক দেখতে পাই—পরম সত্তার সাথে একাত্মতার ক্ষণস্থায়ী চেতনা অনুভব করি।

আমি বিশ্বাস করি পরম সুখ সেই পরম সত্তার প্রতি সেই বিশ্বাসী শিশুর মনোভাব বজায় রাখার মধ্যে নিহিত, যে তার পিতামাতার ভালোবাসায়—তাদের প্রজ্ঞায় কোনো সন্দেহ পোষণ না করে—তার ছোট্ট হাতটি তাদের হাতে রাখে এবং বলে "তুমি আমাকে পথ দেখাও।"

আমি বিশ্বাস করি যে পরম সত্তার প্রতি সেই শিশুর মতো বিশ্বাস অনুভব করে, যে তার ক্লান্ত ছোট্ট মাথা মায়ের বুকের কাছে রাখে, সে মায়ের হৃদয়ের সেই কোমল সাড়া অনুভব করবে, যখন শিশুটিকে আরও একটু মায়ের বুকের কাছে টেনে নেওয়া হয়।


**অধ্যায় ১। চিন্তার জগতে আকর্ষণের নিয়ম**


এক মহান নিয়ম—চিন্তা শক্তির একটি প্রকাশ—চিন্তা কম্পন—

আলো ও তাপের কম্পন কেবল কম্পনের হারে ভিন্ন—মানুষের মস্তিষ্কই একমাত্র যন্ত্র যা চিন্তা-তরঙ্গ অনুভব করতে সক্ষম—টেলিপ্যাথির পরীক্ষা চিন্তার আকর্ষণের নিয়ম প্রমাণ করে—চিন্তার জগতে সমরূপ সমরূপকে আকর্ষণ করে—মনের বেতার টেলিগ্রাফি—প্রতিষ্ঠিত নিয়ম সহ শক্তির একটি ক্ষেত্র।


মহাবিশ্ব নিয়ম দ্বারা শাসিত—এক মহান নিয়ম। এর প্রকাশ বহুবিধ, কিন্তু চূড়ান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নিয়ম কেবল একটিই। আমরা এর কিছু প্রকাশের সাথে পরিচিত, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবুও আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে শিখছি—অবগুণ্ঠন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে।


আমরা মহাকর্ষের নিয়ম সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করি, কিন্তু সেই সমান বিস্ময়কর প্রকাশ, চিন্তার জগতের আকর্ষণের নিয়মকে উপেক্ষা করি। আমরা সেই বিস্ময়কর নিয়মের প্রকাশের সাথে পরিচিত যা পদার্থের পরমাণুগুলিকে আকর্ষণ করে এবং ধরে রাখে—আমরা সেই নিয়মের শক্তিকে স্বীকার করি যা বস্তুগুলিকে পৃথিবীর দিকে আকর্ষণ করে, যা ঘূর্ণায়মান জগৎগুলিকে তাদের স্থানে ধরে রাখে, কিন্তু আমরা সেই শক্তিশালী নিয়মের প্রতি চোখ বন্ধ করে রাখি যা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত বা ভীতিকর জিনিসগুলিকে আমাদের দিকে আকর্ষণ করে, যা আমাদের জীবন গড়ে বা নষ্ট করে।


যখন আমরা বুঝতে পারব যে চিন্তা একটি শক্তি—শক্তির একটি প্রকাশ—যার চুম্বকের মতো আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে, তখন আমরা এমন অনেক কিছুর কারণ ও তাৎপর্য বুঝতে শুরু করব যা এতদিন আমাদের কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। চিন্তার জগতের এই শক্তিশালী নিয়ম—আকর্ষণের নিয়মের কার্যকারিতা অধ্যয়ন করার মতো মূল্যবান অধ্যয়ন শিক্ষার্থীর সময় ও কষ্টের জন্য আর কিছুই হবে না।


যখন আমরা চিন্তা করি, তখন আমরা একটি সূক্ষ্ম ইথারীয় পদার্থের কম্পন প্রেরণ করি, যা আলো, তাপ, বিদ্যুৎ, চুম্বকত্বের মতো বাস্তব কম্পনের মতোই বাস্তব। এই কম্পনগুলি আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কাছে স্পষ্ট নয়, তা তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ নয়। একটি শক্তিশালী চুম্বক কম্পন প্রেরণ করবে এবং একশত পাউন্ড ওজনের ইস্পাতকে আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট শক্তি প্রয়োগ করবে, কিন্তু আমরা সেই শক্তিশালী শক্তিকে দেখতে, স্বাদ নিতে, গন্ধ নিতে, শুনতে বা অনুভব করতে পারি না। একইভাবে, এই চিন্তার কম্পনগুলি সাধারণ উপায়ে দেখা, স্বাদ নেওয়া, গন্ধ নেওয়া, শোনা বা অনুভব করা যায় না; যদিও এটা সত্য যে মানসিক ধারণার প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল ব্যক্তিদের শক্তিশালী চিন্তা-তরঙ্গ উপলব্ধি করার ঘটনার নথিভুক্ত প্রমাণ রয়েছে, এবং আমাদের মধ্যে অনেকেই সাক্ষ্য দিতে পারে যে আমরা প্রেরকের উপস্থিতিতে এবং দূরত্বে অন্যদের চিন্তার কম্পন স্পষ্টভাবে অনুভব করেছি। টেলিপ্যাথি এবং এর সম্পর্কিত ঘটনাগুলি অলস স্বপ্ন নয়। 

আলো এবং তাপ চিন্তার তুলনায় অনেক কম তীব্রতার কম্পনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, কিন্তু পার্থক্যটি কেবল কম্পনের হারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রশ্নের উপর একটি আকর্ষণীয় আলোকপাত করা হয়েছে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক এলিশা গ্রে তার ছোট বই "দ্য মিরাকলস অফ নেচার"-এ বলেছেন: "এই চিন্তায় অনেক জল্পনা করার অবকাশ রয়েছে যে এমন শব্দ-তরঙ্গ বিদ্যমান যা কোনও মানুষের কান শুনতে পায় না, এবং আলোর এমন বর্ণ-তরঙ্গ যা কোনও চোখ দেখতে পায় না। প্রতি সেকেন্ডে 40,000 এবং 400,000,000,000,000 কম্পনের মধ্যে দীর্ঘ, অন্ধকার, নীরব স্থান, এবং প্রতি সেকেন্ডে 700,000,000,000,000 কম্পনের বাইরে অসীম পরিসীমা, যেখানে আলো শেষ হয়, গতির মহাবিশ্বে জল্পনা করার সুযোগ করে দেয়।"


এম. এম. উইলিয়ামস, তার "শর্ট চ্যাপ্টার্স ইন সায়েন্স" নামক গ্রন্থে বলেছেন: "সবচেয়ে দ্রুত স্পন্দন বা কম্পন যা আমাদের শ্রবণের অনুভূতি তৈরি করে, এবং সবচেয়ে ধীর স্পন্দন যা আমাদের মৃদু উষ্ণতার অনুভূতি জাগায়, তাদের মধ্যে কোনও ধারাবাহিকতা নেই। তাদের মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান রয়েছে, যা গতির আরেকটি জগৎকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত, যা আমাদের শব্দ জগৎ এবং আমাদের তাপ ও আলোর জগতের মধ্যে অবস্থিত; এবং এমন কোনও সঙ্গত কারণ নেই যা ধরে নেওয়া যায় যে পদার্থ এই মধ্যবর্তী কার্যকলাপ করতে অক্ষম, বা এই কার্যকলাপ মধ্যবর্তী অনুভূতির জন্ম দিতে পারে না, যদি তাদের গতিবিধি গ্রহণ এবং সংবেদনশীল করার জন্য অঙ্গ থাকে।"


আমি উপরের কর্তৃপক্ষদের উদ্ধৃত করছি কেবল আপনাকে চিন্তার খোরাক দেওয়ার জন্য, চিন্তার কম্পন বিদ্যমান এই সত্যটি প্রমাণ করার চেষ্টা করার জন্য নয়। শেষোক্ত বিষয়টি বিষয়ের অসংখ্য অনুসন্ধিৎসু গবেষকের সন্তুষ্টির জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং সামান্য চিন্তা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে এটি আপনার নিজের অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।


আমরা প্রায়শই সুপরিচিত মানসিক বিজ্ঞান বিষয়ক উক্তিটি পুনরাবৃত্তি করতে শুনি, "চিন্তা জিনিস," এবং আমরা না জেনেই এই কথাগুলি আওড়াই যে উক্তিটির অর্থ কী। যদি আমরা উক্তিটির সত্যতা এবং এর পেছনের সত্যের স্বাভাবিক পরিণতি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারতাম, তবে আমরা এমন অনেক কিছু বুঝতে পারতাম যা আমাদের কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়েছে, এবং আমরা সেই বিস্ময়কর শক্তি, চিন্তাশক্তিকে ব্যবহার করতে সক্ষম হতাম, ঠিক যেমন আমরা অন্য কোনও শক্তির প্রকাশ ব্যবহার করি। 


যেমন আমি বলেছি, যখন আমরা চিন্তা করি, তখন আমরা অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার কম্পন সৃষ্টি করি, "তবে ঠিক আলো, তাপ, শব্দ, বিদ্যুতের কম্পনের মতোই বাস্তব।" এবং যখন আমরা এই কম্পনগুলির উৎপাদন ও সঞ্চালনের নিয়মগুলি বুঝতে পারব, তখন আমরা সেগুলিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করতে সক্ষম হব, ঠিক যেমন আমরা সুপরিচিত শক্তির রূপগুলিকে ব্যবহার করি। আমরা এই কম্পনগুলিকে দেখতে, শুনতে, ওজন করতে বা পরিমাপ করতে পারি না, তা তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ নয়। এমন শব্দ তরঙ্গ বিদ্যমান যা কোনও মানুষের কান শুনতে পায় না, যদিও এর কিছু নিঃসন্দেহে কিছু পোকামাকড়ের কান দ্বারা নিবন্ধিত হয়, এবং অন্যগুলি মানুষের উদ্ভাবিত সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক যন্ত্র দ্বারা ধরা পড়ে; তবুও সবচেয়ে সূক্ষ্ম যন্ত্র দ্বারা নিবন্ধিত শব্দ এবং মানুষের মন, সাদৃশ্যের মাধ্যমে যুক্তি দিয়ে, শব্দ তরঙ্গ এবং অন্য কিছু ধরণের কম্পনের মধ্যেকার সীমারেখা হিসাবে যা জানে তার মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান রয়েছে। এবং এমন আলোক তরঙ্গ রয়েছে যা মানুষের চোখ নিবন্ধন করে না, যার কিছু আরও সূক্ষ্ম যন্ত্র দ্বারা সনাক্ত করা যেতে পারে, এবং আরও অনেক সূক্ষ্ম যে সেই যন্ত্রটি এখনও উদ্ভাবিত হয়নি যা তাদের সনাক্ত করবে, যদিও প্রতি বছর উন্নতি হচ্ছে এবং অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্র ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।


নতুন যন্ত্র উদ্ভাবিত হওয়ার সাথে সাথে, তাদের দ্বারা নতুন কম্পন নিবন্ধিত হয়—এবং তবুও যন্ত্র আবিষ্কারের আগে কম্পনগুলি ঠিক ততটাই বাস্তব ছিল যতটা পরে। ধরুন আমাদের কাছে চুম্বকত্ব নিবন্ধ করার কোনও যন্ত্র নেই—কেউ সেই শক্তিশালী শক্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করতে ন্যায়সঙ্গত হতে পারে, কারণ এটি স্বাদ নেওয়া, অনুভব করা, গন্ধ নেওয়া, শোনা, দেখা, ওজন করা বা পরিমাপ করা যায় না। এবং তবুও সেই শক্তিশালী চুম্বকটি শত শত পাউন্ড ওজনের ইস্পাতের টুকরোগুলিকে আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী তরঙ্গ প্রেরণ করবে।


প্রতিটি ধরণের কম্পনের নিবন্ধনের জন্য নিজস্ব ধরণের যন্ত্রের প্রয়োজন। বর্তমানে মানুষের মস্তিষ্কই একমাত্র যন্ত্র যা চিন্তার তরঙ্গ নিবন্ধন করতে সক্ষম বলে মনে হয়, যদিও গুপ্তবাদীরা বলেন যে এই শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা এমন সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করবেন যা এই জাতীয় ধারণাগুলি ধরতে এবং নিবন্ধন করতে যথেষ্ট সংবেদনশীল হবে। এবং বর্তমান ইঙ্গিতগুলি থেকে মনে হচ্ছে যেন সেই উদ্ভাবন যে কোনও সময় আশা করা যেতে পারে। চাহিদা বিদ্যমান এবং নিঃসন্দেহে শীঘ্রই তা পূরণ হবে। তবে যারা ব্যবহারিক টেলিপ্যাথির লাইনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তাদের নিজস্ব পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া আর কোনও প্রমাণের প্রয়োজন নেই। 


আমরা প্রতিনিয়ত কমবেশি তীব্রতার চিন্তা প্রেরণ করছি এবং আমরা সেই চিন্তার ফল ভোগ করছি। আমাদের চিন্তার তরঙ্গ কেবল আমাদের এবং অন্যদেরকেই প্রভাবিত করে না, বরং তাদের একটি আকর্ষণ করার ক্ষমতাও রয়েছে—তারা আমাদের মনের প্রধান চিন্তার চরিত্রের সাথে সঙ্গতি রেখে অন্যদের চিন্তা, জিনিস, পরিস্থিতি, মানুষ, "ভাগ্য" আমাদের দিকে আকর্ষণ করে। ভালোবাসার চিন্তা আমাদের দিকে অন্যদের ভালোবাসা আকর্ষণ করবে; চিন্তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতি এবং পরিবেশ; একই চিন্তার মানুষ। ক্রোধ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা এবং ঈর্ষার চিন্তা অন্যদের মন থেকে নির্গত অনুরূপ নোংরা চিন্তার ঝাঁককে আমাদের দিকে টেনে আনবে; এমন পরিস্থিতি যেখানে আমাদের এই জঘন্য চিন্তাগুলি প্রকাশ করতে হবে এবং পরিবর্তে অন্যদের কাছ থেকে সেগুলি গ্রহণ করতে হবে; এমন মানুষ যারা অসঙ্গতি প্রকাশ করবে; এবং আরও অনেক কিছু।


একটি শক্তিশালী চিন্তা, বা দীর্ঘস্থায়ী চিন্তা, আমাদের অন্যদের অনুরূপ চিন্তার তরঙ্গের আকর্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করবে। চিন্তার জগতে সমরূপ সমরূপকে আকর্ষণ করে—যেমন বীজ বপন করবে তেমনই ফসল কাটবে। চিন্তার জগতে সমজাতীয়রা একত্র হয়—অভিশাপ মুরগির মতো ঘরে ফিরে আসে এবং তাদের বন্ধুদের সাথে নিয়ে আসে।


যে পুরুষ বা মহিলা ভালোবাসায় পূর্ণ, সে চারদিকে ভালোবাসা দেখে এবং অন্যদের ভালোবাসা আকর্ষণ করে। যার হৃদয়ে ঘৃণা, সে তার সহ্য করার মতো সমস্ত ঘৃণাই পায়। যে ব্যক্তি সাধারণত লড়াইয়ের চিন্তা করে, সে শেষ করার আগেই তার ইচ্ছামতো সমস্ত লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়। আর এভাবেই চলে, প্রত্যেকেই মনের বেতার টেলিগ্রাফির মাধ্যমে যা চায় তাই পায়। যে ব্যক্তি সকালে "বদমেজাজি" বোধ করে ওঠে, সে সাধারণত প্রাতঃরাশ শেষ হওয়ার আগেই পুরো পরিবারকে একই মেজাজে আনতে সক্ষম হয়। "নাক উঁচু" মহিলা সাধারণত দিনের বেলা তার "নাক উঁচু" প্রবণতা পরিতৃপ্ত করার মতো যথেষ্ট জিনিস খুঁজে পায়।


এই চিন্তার আকর্ষণ বিষয়টি গুরুতর। যখন আপনি এটি নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন, তখন আপনি দেখবেন যে একজন মানুষ সত্যিই তার নিজের পরিবেশ তৈরি করে, যদিও সে তার জন্য অন্যদের দোষ দেয়। আমি এমন লোকদের চিনি যারা এই নিয়মটি বুঝতে পেরে ইতিবাচক, শান্ত চিন্তা ধরে রেখেছিল এবং তাদের চারপাশের অসঙ্গতি দ্বারা একেবারেই প্রভাবিত হয়নি। তারা সেই পাত্রের মতো ছিল যেখান থেকে উত্তাল জলে তেল ঢালা হয়েছিল—তাদের চারপাশে ঝড় উঠলেও তারা নিরাপদে এবং শান্তভাবে বিশ্রাম করছিল। যে ব্যক্তি নিয়মের কার্যকারিতা শিখেছে, সে চিন্তার খামখেয়ালী ঝড়ের শিকার হয় না। 

আমরা শারীরিক শক্তির যুগ পেরিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের যুগে প্রবেশ করেছি, এবং এখন আমরা একটি নতুন এবং প্রায় অজানা ক্ষেত্রে প্রবেশ করছি, যা মানসিক শক্তির ক্ষেত্র। শক্তির এই ক্ষেত্রের নিজস্ব প্রতিষ্ঠিত নিয়ম রয়েছে, যেমন অন্যদেরও রয়েছে, এবং আমাদের সেগুলির সাথে পরিচিত হওয়া উচিত, অন্যথায় আমরা শ্রমের স্তরে অজ্ঞদের মতো কোণঠাসা হয়ে যাব। আমি আপনাদের কাছে শক্তির এই নতুন ক্ষেত্রের মহান অন্তর্নিহিত নীতিগুলি স্পষ্ট করার চেষ্টা করব যা আমাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে, যাতে আপনারা এই মহান শক্তি ব্যবহার করতে এবং বৈধ ও যোগ্য উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করতে পারেন, ঠিক যেমন মানুষ আজ বাষ্প, বিদ্যুৎ এবং শক্তির অন্যান্য রূপ ব্যবহার করছে। 


**অধ্যায় ২। চিন্তাতরঙ্গ এবং তাদের পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া**


কীভাবে চিন্তাতরঙ্গ মনের সাগরে পরিভ্রমণ করে—নিজেদের পুনরুৎপাদন করার ক্ষমতা—যে কম্পনগুলি আমাদের প্রভাবিত করে—যেগুলি করে না—কেন?—আমরা নিজেদের চিন্তার মাধ্যমেই নিজেদেরকে যা বানিয়েছি—আমাদের ভাগ্য গঠনে অন্যদের চিন্তার ভূমিকা—মারকনি বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে আকর্ষণের নিয়মের কার্যকারিতা—মনের বিভিন্ন তীব্রতা রয়েছে—ইতিবাচক চিন্তা—নেতিবাচক চিন্তা—আমরা কারও কাছে ইতিবাচক, কারও কাছে নেতিবাচক—মানসিক আইনের জ্ঞান আমাদের নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক করতে পারে—ইতিবাচক স্তরের চেয়ে নেতিবাচক স্তরে বেশি মানুষ—ফলস্বরূপ, আরও নেতিবাচক চিন্তাতরঙ্গ—কীভাবে তাদের ভারসাম্য বজায় রাখা যায়—দৃঢ় উক্তি এবং স্ব-পরামর্শ, এবং তাদের ব্যবহার—নতুন মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করা—ইচ্ছাশক্তির বিকাশ—সর্বদা উচ্চ তীব্রতা কাম্য নয়—ইচ্ছানুসারে ইতিবাচক থেকে গ্রহণশীল অবস্থায় পরিবর্তনের সুবিধা।


জলে নিক্ষিপ্ত পাথরের মতো, চিন্তা তরঙ্গ এবং ঢেউ তৈরি করে যা চিন্তার বিশাল সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ে। তবে, এর একটি পার্থক্য রয়েছে: জলের ঢেউ কেবল একটি সমতলে সব দিকে চলে, যেখানে চিন্তাতরঙ্গ একটি সাধারণ কেন্দ্র থেকে সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সূর্যের রশ্মির মতো।


ঠিক যেমন আমরা পৃথিবীতে বাতাসের এক বিশাল সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত, তেমনই আমরা মনের এক বিশাল সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমাদের চিন্তাতরঙ্গ এই বিশাল মানসিক ইথারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তবে, যেমন আমি ব্যাখ্যা করেছি, সব দিকে প্রসারিত হয়, অতিক্রান্ত দূরত্বের কারণে তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পায়, কারণ আমাদের চারপাশের মনের বিশাল দেহের সাথে তরঙ্গের সংস্পর্শের ফলে ঘর্ষণ সৃষ্টি হয়। 

এই চিন্তাতরঙ্গগুলির জলের ঢেউয়ের থেকে ভিন্ন অন্যান্য গুণাবলীও রয়েছে। এদের নিজেদের পুনরুৎপাদন করার ক্ষমতা আছে। এই ক্ষেত্রে, এরা জলের ঢেউয়ের চেয়ে শব্দ-তরঙ্গের সাথে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। ঠিক যেমন বেহালার একটি সুর পাতলা কাঁচকে কম্পিত করে এবং "গান" গাইতে বাধ্য করে, তেমনই একটি শক্তিশালী চিন্তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত মনে অনুরূপ কম্পন জাগাতে থাকে। আমাদের কাছে আসা অনেক "বিচ্ছিন্ন চিন্তা" আসলে অন্য কারও পাঠানো শক্তিশালী চিন্তার প্রতিফলন বা প্রতিধ্বনি। কিন্তু যদি আমাদের মন তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত না থাকে, তবে সেই চিন্তা সম্ভবত আমাদের প্রভাবিত করবে না। যদি আমরা উচ্চ এবং মহৎ চিন্তা করি, তবে আমাদের মন সেই চিন্তার চরিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি নির্দিষ্ট মূলসুর অর্জন করে। এবং একবার এই মূলসুর প্রতিষ্ঠিত হলে, আমরা একই চিন্তায় আবদ্ধ অন্যান্য মনের কম্পনগুলি ধরতে সক্ষম হব। অন্যদিকে, আসুন আমরা বিপরীত চরিত্রের চিন্তা করার অভ্যাস করি, এবং শীঘ্রই আমরা একই ধারায় চিন্তা করা হাজার হাজার মনের নিম্ন স্তরের চিন্তার প্রতিধ্বনি করতে শুরু করব।


আমরা মূলত নিজেদের চিন্তার মাধ্যমেই নিজেদেরকে যা বানিয়েছি, বাকিটা অন্যদের পরামর্শ এবং চিন্তার চরিত্র দ্বারা গঠিত, যা হয় সরাসরি মৌখিক পরামর্শের মাধ্যমে বা টেলিপ্যাথিকভাবে এই চিন্তাতরঙ্গের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তবে, আমাদের সাধারণ মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত চিন্তাতরঙ্গ এবং আমাদের নিজেদের থেকে নির্গত চিন্তার চরিত্র নির্ধারণ করে। আমরা কেবল সেই চিন্তাগুলিই গ্রহণ করি যা আমাদের নিজেদের ধারণ করা সাধারণ মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন চিন্তাগুলি আমাদের খুব কমই প্রভাবিত করে, কারণ তারা আমাদের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জাগায় না।


যে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে নিজের উপর বিশ্বাস রাখে এবং আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় সংকল্পের একটি ইতিবাচক শক্তিশালী মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখে, সে সম্ভবত অন্যদের মন থেকে নির্গত হতাশা ও ব্যর্থতার বিরূপ এবং নেতিবাচক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হবে না, যাদের মধ্যে এই শেষোক্ত গুণাবলী প্রধান। একই সময়ে, এই নেতিবাচক চিন্তাগুলি, যদি তারা এমন কারও কাছে পৌঁছায় যার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিম্ন স্তরে আবদ্ধ, তবে তার নেতিবাচক অবস্থাকে আরও গভীর করে এবং তার শক্তি গ্রাসকারী আগুনে ইন্ধন যোগ করে, অথবা, যদি আপনি এই উপমা পছন্দ করেন, তবে তার শক্তি এবং কার্যকলাপের আগুনকে আরও নিভিয়ে দেয়। 

আমরা একই ধরনের চিন্তার অন্যদের চিন্তা নিজেদের দিকে আকর্ষণ করি। যে ব্যক্তি সাফল্যের চিন্তা করে, সে সম্ভবত সেইরকম চিন্তা করা অন্যদের মনের সাথে সুর মেলাবে, এবং তারা তাকে সাহায্য করবে, এবং সে তাদের। যে ব্যক্তি তার মনকে ক্রমাগত ব্যর্থতার চিন্তায় মগ্ন রাখে, সে নিজেকে অন্যান্য "ব্যর্থ" মানুষদের মনের কাছাকাছি নিয়ে আসে, এবং প্রত্যেকেই একে অপরকে আরও বেশি করে টেনে নামাবে। যে ব্যক্তি মনে করে সবকিছুই খারাপ, সে সম্ভবত অনেক খারাপ দেখতে পাবে এবং এমন অন্যদের সংস্পর্শে আসবে যারা তার তত্ত্ব প্রমাণ করবে বলে মনে হবে। আর যে ব্যক্তি সবকিছু এবং সবার মধ্যে ভালো কিছু খোঁজে, সে সম্ভবত তার চিন্তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ জিনিস এবং মানুষদের নিজের দিকে আকর্ষণ করবে। আমরা সাধারণত সেটাই দেখি যা আমরা খুঁজি।


আপনি যদি মারকনির বেতার যন্ত্রগুলির কথা ভাবেন তবে এই ধারণাটি আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন, যা কেবলমাত্র সেই প্রেরণ যন্ত্র থেকে কম্পন গ্রহণ করে যা একই সুরে বাঁধা হয়েছে, যখন অন্যান্য টেলিগ্রাম কাছাকাছি বাতাসে প্রবাহিত হচ্ছে যন্ত্রটিকে প্রভাবিত না করে। চিন্তার ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। আমরা কেবল সেটাই গ্রহণ করি যা আমাদের মানসিক সুরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যদি আমরা হতাশ হয়ে থাকি, তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে আমরা একটি নেতিবাচক সুরে নেমে এসেছি এবং কেবল আমাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা দ্বারাই প্রভাবিত হইনি, বরং অনুরূপ চরিত্রের অতিরিক্ত হতাশাজনক চিন্তাভাবনাও গ্রহণ করেছি যা ক্রমাগত অন্যান্য দুর্ভাগা ব্যক্তিদের মন থেকে প্রেরিত হচ্ছে যারা এখনও চিন্তার জগতে আকর্ষণের নিয়ম শিখেনি। এবং যদি আমরা মাঝে মাঝে উৎসাহ এবং শক্তির উচ্চতায় উঠি, তবে আমরা কত দ্রুত বিশ্বের জীবন্ত পুরুষ ও মহিলাদের দ্বারা প্রেরিত সাহসী, দুঃসাহসী, উদ্যমী, ইতিবাচক চিন্তাভাবনার অন্তঃপ্রবাহ অনুভব করি। যখন আমরা ব্যক্তিগতভাবে লোকেদের সংস্পর্শে আসি এবং তাদের কম্পন অনুভব করি, তা হতাশাজনক হোক বা উদ্দীপক, যেমনটি হোক না কেন, তখন আমরা এটি খুব বেশি অসুবিধা ছাড়াই চিনতে পারি। তবে যখন আমরা তাদের সান্নিধ্যে থাকি না তখনও একই নিয়ম কাজ করে, যদিও তা কম শক্তিশালীভাবে।

মনের অনেক স্তর রয়েছে, সর্বোচ্চ ইতিবাচক সুর থেকে সর্বনিম্ন নেতিবাচক সুর পর্যন্ত বিস্তৃত, যার মধ্যে অনেক মধ্যবর্তী সুর রয়েছে, যা ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রান্ত থেকে তাদের নিজ নিজ দূরত্বের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।


যখন আপনার মন ইতিবাচক ধারায় কাজ করে, তখন আপনি শক্তিশালী, প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল, প্রফুল্ল, সুখী, আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী বোধ করেন এবং আপনার কাজ ভালোভাবে করতে, আপনার উদ্দেশ্যগুলি সম্পন্ন করতে এবং সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। আপনি শক্তিশালী ইতিবাচক চিন্তা প্রেরণ করেন, যা অন্যদের প্রভাবিত করে এবং তাদের নিজস্ব মানসিক মূলসুরের উপর নির্ভর করে আপনার সাথে সহযোগিতা করতে বা আপনার নেতৃত্ব অনুসরণ করতে বাধ্য করে।


যখন আপনি মানসিক কীবোর্ডের চরম নেতিবাচক প্রান্তে বাজান, তখন আপনি হতাশ, দুর্বল, নিষ্ক্রিয়, নিস্তেজ, ভীতু, কাপুরুষোচিত বোধ করেন। এবং আপনি নিজেকে অগ্রগতি করতে বা সফল হতে অক্ষম মনে করেন। এবং অন্যদের উপর আপনার প্রভাব কার্যত কিছুই থাকে না। আপনি অন্যদের নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে তাদের দ্বারা চালিত হন এবং আরও ইতিবাচক ব্যক্তিদের দ্বারা মানব দরজার মাদুর বা ফুটবল হিসাবে ব্যবহৃত হন।


কিছু ব্যক্তির মধ্যে ইতিবাচক উপাদান প্রধান বলে মনে হয়; এবং অন্যদের মধ্যে নেতিবাচক গুণ বেশি স্পষ্ট বলে মনে হয়। অবশ্যই, ইতিবাচকতা এবং নেতিবাচকতার বিভিন্ন মাত্রার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে, এবং 'খ' 'ক'-এর কাছে নেতিবাচক হতে পারে, আবার 'গ'-এর কাছে ইতিবাচক হতে পারে। যখন দুজন ব্যক্তি প্রথম মিলিত হয়, তখন সাধারণত একটি নীরব মানসিক সংঘাত হয় যেখানে তাদের নিজ নিজ মন তাদের ইতিবাচকতার গুণ পরীক্ষা করে এবং একে অপরের প্রতি তাদের আপেক্ষিক অবস্থান নির্ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি অচেতন হতে পারে, তবে এটি ঘটে। সামঞ্জস্য প্রায়শই স্বয়ংক্রিয় হয়, তবে মাঝে মাঝে সংগ্রাম এত তীব্র হয়—প্রতিপক্ষরা এতটাই সমকক্ষ হয়—যে বিষয়টি দুটি ব্যক্তির সচেতনতায় প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। কখনও কখনও উভয় পক্ষই তাদের ইতিবাচকতার মাত্রায় এতটাই একই রকম হয় যে তারা কার্যত মানসিকভাবে সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হয়; তারা কখনই একে অপরের সাথে সত্যিই মানিয়ে নিতে পারে না এবং হয় পরস্পর বিতাড়িত হয়ে আলাদা হয়ে যায়, অথবা অবিরাম কলহ ও ঝগড়ার মধ্যে একসাথে থাকে। 

আমরা যাদের সাথে সম্পর্ক রাখি তাদের প্রত্যেকের কাছে ইতিবাচক বা নেতিবাচক। আমরা আমাদের সন্তান, কর্মচারী এবং নির্ভরশীলদের কাছে ইতিবাচক হতে পারি, কিন্তু একই সময়ে আমরা অন্যদের কাছে নেতিবাচক যাদের কাছে আমরা অধস্তন অবস্থানে থাকি, অথবা যাদের আমরা নিজেদের উপর কর্তৃত্ব করতে দিয়েছি।


অবশ্যই, কিছু ঘটতে পারে এবং আমরা হঠাৎ করে সেই পুরুষ বা মহিলার চেয়ে বেশি ইতিবাচক হয়ে উঠব যাদের কাছে আমরা আগে নেতিবাচক ছিলাম। আমরা প্রায়শই এই ধরনের ঘটনা দেখি। এবং যখন এই মানসিক নিয়মগুলির জ্ঞান আরও সাধারণ হবে, তখন আমরা আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেখতে পাব যেখানে লোকেরা নিজেদেরকে জাহির করছে এবং তাদের নতুন আবিষ্কৃত শক্তি ব্যবহার করছে।


তবে মনে রাখবেন ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে আপনি আপনার মনের মূল সুরকে একটি ইতিবাচক উচ্চতায় উন্নীত করার ক্ষমতা রাখেন। এবং অবশ্যই, এটিও সমান সত্য যে আপনি অসাবধানতা বা দুর্বল ইচ্ছাশক্তির কারণে নিজেকে একটি নিম্ন, নেতিবাচক সুরে নামতে দিতে পারেন।


ইতিবাচক চিন্তার স্তরের চেয়ে নেতিবাচক চিন্তার স্তরে বেশি লোক রয়েছে এবং ফলস্বরূপ আমাদের মানসিক পরিবেশে আরও বেশি নেতিবাচক চিন্তার কম্পন ক্রিয়াশীল রয়েছে। তবে, আমাদের সৌভাগ্যবশত, এটি এই সত্য দ্বারা প্রতিহত হয় যে একটি ইতিবাচক চিন্তা একটি নেতিবাচক চিন্তার চেয়ে অসীম গুণ বেশি শক্তিশালী, এবং যদি আমরা ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজেদেরকে একটি উচ্চতর মানসিক স্তরে উন্নীত করি তবে আমরা হতাশাজনক চিন্তাগুলিকে বাদ দিতে পারি এবং আমাদের পরিবর্তিত মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কম্পনগুলি গ্রহণ করতে পারি। এটি মানসিক বিজ্ঞান এবং অন্যান্য নতুন চিন্তাধারার বিভিন্ন স্কুলের ব্যবহৃত নিশ্চিতকরণ এবং স্ব-পরামর্শের অন্যতম রহস্য। নিশ্চিতকরণের নিজস্ব কোনও বিশেষ গুণ নেই, তবে তারা দ্বিগুণ উদ্দেশ্য পরিবেশন করে: (১) তারা আমাদের মধ্যে নতুন মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে এবং চরিত্র গঠনে—নিজেকে নতুন করে তৈরি করার বিজ্ঞানে—অসাধারণভাবে কাজ করে। (২) তারা মানসিক মূল সুরকে উন্নত করতে সাহায্য করে যাতে আমরা একই চিন্তার স্তরের অন্যদের ইতিবাচক চিন্তার তরঙ্গ থেকে উপকৃত হতে পারি। 

আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, আমরা প্রতিনিয়ত নিশ্চিতকরণ করে চলেছি। যে ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে বলে যে সে একটি কাজ করতে পারে এবং করবে—এবং আন্তরিকভাবে তা বলে—সে নিজের মধ্যে সেই কাজটি ভালোভাবে করার জন্য সহায়ক গুণাবলী বিকাশ করে এবং একই সাথে তার মনকে সেই সঠিক স্তরে স্থাপন করে যা কাজটি করার ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করতে পারে এমন সমস্ত চিন্তাতরঙ্গ গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে, যদি কেউ বলে এবং অনুভব করে যে সে ব্যর্থ হতে চলেছে, তবে সে তার নিজের অবচেতন মন থেকে আসা সেই চিন্তাগুলিকে দমন করবে এবং শ্বাসরোধ করবে যা তাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, এবং একই সাথে নিজেকে বিশ্বের ব্যর্থতা-চিন্তার সাথে সুর মেলাবে—এবং সেই ধরণের চিন্তাভাবনা আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, আমি আপনাকে বলতে পারি।


আপনার চারপাশের বিরূপ এবং নেতিবাচক চিন্তাভাবনা দ্বারা নিজেদেরকে প্রভাবিত হতে দেবেন না। আপনার মানসিক আবাসস্থলের উচ্চ কক্ষে উঠুন এবং নিম্ন স্তরের চিন্তার কম্পনের অনেক উপরে একটি শক্তিশালী সুরে নিজেকে বেঁধে ফেলুন। তখন আপনি কেবল তাদের নেতিবাচক কম্পন থেকে মুক্তই হবেন না, বরং আপনার নিজস্ব বিকাশের স্তরের ব্যক্তিদের কাছ থেকে আসা শক্তিশালী ইতিবাচক চিন্তার বিশাল দেহের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন।


আমার লক্ষ্য হবে চিন্তা ও ইচ্ছাশক্তির সঠিক ব্যবহারে আপনাকে দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে আপনি নিজেকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন এবং যখনই প্রয়োজন মনে করেন তখনই ইতিবাচক সুরে আঘাত করতে সক্ষম হন। সব অনুষ্ঠানে চরম সুরে আঘাত করা প্রয়োজন নয়। ভালো পরিকল্পনা হল নিজেকে খুব বেশি চাপ ছাড়াই একটি আরামদায়ক সুরে রাখা এবং এমন উপায় হাতের কাছে রাখা যার মাধ্যমে প্রয়োজনের সময় আপনি অবিলম্বে সুর বাড়াতে পারেন। এই জ্ঞানের মাধ্যমে আপনি মনের পুরানো স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়াকলাপের করুণায় থাকবেন না, বরং এটিকে আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।


ইচ্ছাশক্তির বিকাশ অনেকটা পেশী বিকাশের মতো—অনুশীলন এবং ধীরে ধীরে উন্নতির বিষয়। প্রথমে এটি ক্লান্তিকর হতে পারে, তবে প্রতিটি চেষ্টায় একজন শক্তিশালী হয় যতক্ষণ না নতুন শক্তি বাস্তব এবং স্থায়ী হয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই আকস্মিক আহ্বান বা জরুরি অবস্থার অধীনে নিজেদেরকে ইতিবাচক করে তুলেছি। আমরা প্রয়োজনের সময় "নিজেকে প্রস্তুত" করার অভ্যস্ত। তবে বুদ্ধিমান অনুশীলনের মাধ্যমে আপনি এতটাই শক্তিশালী হবেন যে আপনার অভ্যস্ত অবস্থা এখন আপনার "নিজেকে প্রস্তুত" করার পর্যায়ের সমান হবে এবং তারপরে যখন আপনি প্রেরণা প্রয়োগ করা প্রয়োজন মনে করবেন তখন আপনি এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হবেন যা বর্তমানে ধারণার বাইরে।


আমাকে ক্রমাগত উচ্চ উত্তেজনা সমর্থনকারী হিসেবে বুঝবেন না। এটি একেবারেই কাম্য নয়, কেবল এই কারণে নয় যে এটি আপনার উপর খুব বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বরং এই কারণেও যে আপনি সময়ে সময়ে উত্তেজনা উপশম করতে এবং গ্রহণশীল হতে চাইবেন যাতে আপনি ধারণাগুলি শোষণ করতে পারেন। বিশ্রাম নিতে এবং একটি নির্দিষ্ট মাত্রার গ্রহণশীলতা অবলম্বন করতে সক্ষম হওয়া ভাল, জেনে রাখা ভাল যে আপনি সর্বদা ইচ্ছানুসারে আরও ইতিবাচক অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম। অভ্যাগতভাবে দৃঢ়ভাবে ইতিবাচক ব্যক্তি অনেক আনন্দ এবং বিনোদন হারায়। ইতিবাচক, আপনি অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন; গ্রহণশীল, আপনি ধারণা গ্রহণ করেন। ইতিবাচক, আপনি একজন শিক্ষক; গ্রহণশীল, একজন ছাত্র। কেবল একজন ভাল শিক্ষক হওয়াই ভাল জিনিস নয়, তবে সময়ে সময়ে একজন ভাল শ্রোতা হওয়াও খুব গুরুত্বপূর্ণ। 


অন্যদিকে, নিষ্ক্রিয় ধারায় চালিত চিন্তার আবেগ বা গতি-আবেগ একটি সক্রিয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাপ্ত বা সংশোধন করা যেতে পারে। সক্রিয় কার্যকারিতা সৃষ্টি করে, পরিবর্তন করে বা ধ্বংস করে। নিষ্ক্রিয় কার্যকারিতা সক্রিয় কার্যকারিতা দ্বারা প্রদত্ত কাজ চালিয়ে যায় এবং আদেশ ও পরামর্শ মেনে চলে।


সক্রিয় কার্যকারিতা চিন্তা-অভ্যাস বা গতি-অভ্যাস তৈরি করে এবং এটিকে সেই কম্পনগুলি প্রদান করে যা এটিকে পরবর্তীতে নিষ্ক্রিয় ধারায় চালিত করে। সক্রিয় কার্যকারিতার চিন্তার অভ্যাস বা গতি-অভ্যাসের গতিবেগ নিরপেক্ষ করার জন্য কম্পন প্রেরণের ক্ষমতাও রয়েছে; এটি শক্তিশালী কম্পন সহ একটি নতুন চিন্তা-অভ্যাস বা গতি-অভ্যাস শুরু করতেও সক্ষম, যা প্রথম চিন্তা বা গতিকে পরাস্ত করে এবং শোষণ করে এবং নতুনটিকে প্রতিস্থাপন করে।


সমস্ত চিন্তা-আবেগ বা গতি-আবেগ, একবার তাদের কার্যভার শুরু করলে, সক্রিয় কার্যকারিতা বা অন্য নিয়ন্ত্রণকারী শক্তির পরবর্তী আবেগ দ্বারা সংশোধিত বা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় ধারায় কম্পিত হতে থাকে। মূল আবেগের ধারাবাহিকতা এতে গতিবেগ এবং শক্তি যোগ করে এবং এর সংশোধন বা সমাপ্তি আরও কঠিন করে তোলে। এটি "অভ্যাসের শক্তি" নামক বিষয়টির ব্যাখ্যা করে। আমি মনে করি যারা সহজেই অর্জিত একটি অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে সংগ্রাম করেছেন তারা এটি সহজেই বুঝতে পারবেন। এই নিয়মটি ভাল এবং খারাপ উভয় অভ্যাসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নীতিটি স্পষ্ট।


মনের বেশ কয়েকটি অনুষদ প্রায়শই একটি একক প্রকাশ তৈরি করতে একত্রিত হয়। একটি কাজ সম্পাদনের জন্য বেশ কয়েকটি অনুষদের সম্মিলিত অনুশীলনের প্রয়োজন হতে পারে, যার মধ্যে কিছু সক্রিয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং অন্যরা নিষ্ক্রিয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।


নতুন পরিস্থিতি—নতুন সমস্যা—সক্রিয় প্রচেষ্টার অনুশীলনের আহ্বান জানায়; যেখানে একটি পরিচিত সমস্যা বা কাজ তার আরও সক্রিয় ভাইয়ের সাহায্য ছাড়াই নিষ্ক্রিয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে সহজেই সমাধান করা যেতে পারে।

প্রকৃতিতে জীবন্ত প্রাণীদের কিছু নির্দিষ্ট কাজ করার একটি সহজাত প্রবণতা রয়েছে, একটি সুসংগঠিত দেহের সেই জিনিসটি খোঁজার প্রবণতা যা তার জীবদেহের চাহিদা পূরণ করে। এই প্রবণতাকে কখনও কখনও ক্ষুধা (Appetency) বলা হয়। এটি আসলে একটি নিষ্ক্রিয় মানসিক আবেগ, যা প্রাথমিক কারণের (Primal Cause) প্রেরণা থেকে উদ্ভূত এবং বিবর্তনীয় বিকাশের ধারায় প্রেরিত, যা অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে শক্তি ও ক্ষমতা লাভ করে। প্রাথমিক কারণের আবেগকে পরম সত্তার (The Absolute) শক্তিশালী ঊর্ধ্বমুখী আকর্ষণ সাহায্য করে। 

উদ্ভিজ্জ জীবনে এই প্রবণতা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, নিম্ন শ্রেণীর উদ্ভিদে এর সামান্য প্রকাশ থেকে শুরু করে উচ্চ শ্রেণীর উদ্ভিদে বৃহত্তর প্রকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটিকেই সাধারণত উদ্ভিদের "জীবন শক্তি" হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে, এটি নিষ্ক্রিয় প্রচেষ্টার ধারায় কার্যরত প্রাথমিক মানসিকতার একটি প্রকাশ। কিছু উচ্চ শ্রেণীর উদ্ভিজ্জ জীবনে স্বাধীন "জীবন কর্ম"-এর একটি ক্ষীণ আভাস—ইচ্ছাশক্তির ক্ষীণ ইঙ্গিত—দেখা যায়। উদ্ভিদ জীবন নিয়ে লেখকরা এই ঘটনার অনেকRemarkable উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। নিঃসন্দেহে, এটি প্রাথমিক সক্রিয় মানসিকতার একটি প্রদর্শনী। 

নিম্নতর প্রাণীজগতে, নিষ্ক্রিয় মানসিক প্রচেষ্টার একটি খুব উচ্চ মাত্রা দেখা যায়। এবং বিভিন্ন পরিবার এবং প্রজাতিতে ডিগ্রীর ভিন্নতা সহ, সক্রিয় মানসিকতার একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্পষ্ট। নিম্নতর প্রাণী নিঃসন্দেহে মানুষের তুলনায় কেবল কম মাত্রায় যুক্তি ধারণ করে, এবং প্রকৃতপক্ষে, একটি বুদ্ধিমান প্রাণী দ্বারা প্রদর্শিত ইচ্ছাশক্তিপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ প্রায়শই নিম্ন শ্রেণীর মানুষ বা একটি ছোট শিশুর দ্বারা প্রদর্শিত মানসিকতার মতোই উচ্চ হয়।


যেমন একটি শিশু, জন্মের আগে, তার শরীরে মানুষের শারীরিক বিবর্তনের পর্যায়গুলি দেখায়, তেমনই একটি শিশু, জন্মের আগে এবং পরে—পরিপক্কতা পর্যন্ত—মানুষের মানসিক বিবর্তনের পর্যায়গুলি প্রকাশ করে।


মানুষ, অন্তত এই গ্রহে উৎপাদিত জীবনের সর্বোচ্চ রূপ, নিষ্ক্রিয় মানসিকতার সর্বোচ্চ রূপ দেখায় এবং নিম্নতর প্রাণীদের তুলনায় সক্রিয় মানসিকতার অনেক বেশি বিকাশ দেখায়, তবুও সেই ক্ষমতার মাত্রা বিভিন্ন মানবজাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। এমনকি আমাদের জাতির মানুষের মধ্যেও সক্রিয় মানসিকতার বিভিন্ন মাত্রা স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়; এই মাত্রাগুলি কোনওভাবেই ব্যক্তির "সংস্কৃতি", সামাজিক অবস্থান বা শিক্ষাগত সুবিধার পরিমাণের উপর নির্ভর করে না। মানসিক সংস্কৃতি এবং মানসিক বিকাশ দুটি খুব ভিন্ন জিনিস। 

মানুষের মধ্যে সক্রিয় মানসিকতার বিকাশের বিভিন্ন স্তর দেখতে আপনাকে কেবল আপনার চারপাশে তাকাতে হবে। অনেক পুরুষের যুক্তি কেবল নিষ্ক্রিয় মানসিকতার চেয়ে সামান্য বেশি, যা ইচ্ছাশক্তিপূর্ণ চিন্তার গুণাবলীর সামান্যই প্রদর্শন করে। তারা অন্যদের তাদের জন্য ভাবতে দিতে পছন্দ করে। সক্রিয় মানসিকতা তাদের ক্লান্ত করে তোলে এবং তারা সহজাত, স্বয়ংক্রিয়, নিষ্ক্রিয় মানসিক প্রক্রিয়াটিকে অনেক সহজ মনে করে। তাদের মন সর্বনিম্ন প্রতিরোধের পথে কাজ করে। তারা মানুষের ভেড়ার চেয়ে সামান্য বেশি কিছু নয়। 

নিম্নতর প্রাণী এবং নিম্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সক্রিয় মানসিকতা মূলত স্থূলতর অনুষদগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ—আরও বস্তুগত স্তরে; উচ্চতর মানসিক অনুষদগুলি নিষ্ক্রিয় কার্যকারিতার সহজাত, স্বয়ংক্রিয় ধারায় কাজ করে।


বিবর্তনীয় স্কেলে নিম্নতর জীবন রূপগুলি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে তারা নতুন অনুষদ বিকাশ করেছিল, যা তাদের মধ্যে সুপ্ত ছিল। এই অনুষদগুলি সর্বদা প্রাথমিক নিষ্ক্রিয় কার্যকারিতার আকারে প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে উচ্চতর নিষ্ক্রিয় রূপগুলির মাধ্যমে কাজ করে, যতক্ষণ না সক্রিয় কার্যকারিতা কার্যকর হয়। বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে, যার অপরিবর্তনীয় প্রবণতা অত্যন্ত উন্নত সক্রিয় মানসিকতার লক্ষ্যের দিকে। এই বিবর্তনীয় অগ্রগতি প্রাথমিক কারণের (Primal Cause) দ্বারা অর্পিত কম্পনমূলক আবেগ দ্বারা সৃষ্ট, যা পরম সত্তার (The Absolute) ঊর্ধ্বমুখী আকর্ষণ দ্বারা সহায়ক। 

বিবর্তনের এই নিয়ম এখনও চলমান, এবং মানুষ মনের নতুন শক্তি বিকাশ করতে শুরু করেছে, যা অবশ্যই প্রথমে নিষ্ক্রিয় প্রচেষ্টার ধারায় নিজেদের প্রকাশ করছে। কিছু মানুষ এই নতুন অনুষদগুলিকে যথেষ্ট পরিমাণে উন্নত করেছে, এবং সম্ভবত অচিরেই মানুষ তাদের সক্রিয় কার্যাবলীর ধারায় প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে। প্রকৃতপক্ষে, এই ক্ষমতা ইতিমধ্যেই কয়েকজন অর্জন করেছে। এটাই প্রাচ্যের গুপ্তবাদীদের এবং তাদের কিছু পশ্চিমা ভাইদের রহস্য।

মানসিকতাকে ইচ্ছাশক্তির অধীন করবার ক্ষমতা সঠিকভাবে পরিচালিত অনুশীলনের মাধ্যমে বৃদ্ধি করা যায়। আমরা যাকে সাধারণত “ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধি” বলি, প্রকৃতপক্ষে তা হলো মনের এমন এক প্রশিক্ষণ, যার দ্বারা মন অভ্যন্তরস্থ শক্তিকে চিনতে ও গ্রহণ করতে শেখে। ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট শক্তিশালী—তাকে আরও শক্তিশালী করার দরকার নেই; কিন্তু মনকে এমনভাবে গঠিত করতে হয়, যাতে সে ইচ্ছাশক্তির ইঙ্গিত ও নির্দেশ গ্রহণ করতে এবং তা অনুসারে কাজ করতে সক্ষম হয়। ইচ্ছাশক্তি হচ্ছে "আমি আছি" এই আত্মবোধের বাহ্যিক প্রকাশ।


ইচ্ছার যে প্রবাহ তা পূর্ণ শক্তিতে আত্মিক তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে; কিন্তু যতক্ষণ না তুমি শিখো কীভাবে তোমার মানসিক গাড়ির ট্রলি-পোলটি তুলতে হয়—এই বিদ্যুৎ প্রবাহের সংস্পর্শে আনতে হয়—ততক্ষণ পর্যন্ত সেই মানসিক গাড়ি চলবে না। এই ধারণাটি কিছুটা ভিন্ন, ঐ সমস্ত লেখকদের প্রচলিত ব্যাখ্যার তুলনায় যারা ইচ্ছাশক্তি নিয়ে লিখেছেন; কিন্তু এই ব্যাখাই সঠিক, এবং তুমি নিজেই তা প্রমাণ করতে পারবে, যদি তুমি সঠিক পথে এই বিষয়ে পরীক্ষা ও অনুশীলন চালিয়ে যাও।

পরমের আকর্ষণ মানুষকে ঊর্ধ্বমুখী করছে এবং প্রাথমিক আবেগের কম্পনমূলক শক্তি এখনও নিঃশেষ হয়নি। বিবর্তনীয় বিকাশের সময় এসেছে যখন মানুষ নিজেকে সাহায্য করতে পারে। যে ব্যক্তি নিয়ম বোঝে, সে মনের শক্তির বিকাশের মাধ্যমে বিস্ময়কর কাজ করতে পারে; যেখানে যে ব্যক্তি সত্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে নিয়মের জ্ঞানের অভাবে ভুগবে।


যে ব্যক্তি তার মানসিক সত্তার নিয়ম বোঝে, তার সুপ্ত শক্তি বিকাশ করে এবং বুদ্ধিমানের মতো তা ব্যবহার করে। সে তার নিষ্ক্রিয় মানসিক কার্যকারিতাগুলিকে অবজ্ঞা করে না, তবে সেগুলিরও সদ্ব্যবহার করে, সেগুলিকে সেই দায়িত্বগুলি অর্পণ করে যার জন্য সেগুলি সবচেয়ে উপযুক্ত, এবং সেগুলিকে আয়ত্ত করে এবং উচ্চতর আত্মার আদেশ পালনের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজ থেকে বিস্ময়কর ফলাফল পেতে সক্ষম হয়। যখন তারা সঠিকভাবে তাদের কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার জ্ঞান তাকে নির্বোধভাবে তাদের সাথে হস্তক্ষেপ করতে এবং এর ফলে নিজের ক্ষতি করতে বাধা দেয়। সে তার মধ্যে সুপ্ত অনুষদ এবং শক্তি বিকাশ করে এবং সক্রিয় মানসিকতা এবং নিষ্ক্রিয় মানসিকতার ধারায় সেগুলি কীভাবে প্রকাশ করতে হয় তা শেখে। সে জানে যে তার ভেতরের আসল মানুষটিই প্রভু যার কাছে সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় উভয় কার্যকারিতা কেবল সরঞ্জাম। সে ভয় দূর করেছে এবং স্বাধীনতা উপভোগ করে। সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। সে "আমি আছি"-এর রহস্য শিখেছে। 


চতুর্থ অধ্যায়: মন নির্মাণ

মানবের শক্তি—অবচেতন মন-নির্মাণ—"আমি", মনের অধিপতি—সার্বজনীন ইচ্ছাশক্তি—নিম্ন আত্মের উপর কর্তৃত্ব—দায়িত্বজ্ঞানহীন মানসিক শক্তিগুলোর দ্বারা মনশক্তির অপব্যবহার—মানসিক রাজ্যে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা—প্রথম যুদ্ধ—অপ্রকৃত আত্মের উপর প্রকৃত আত্মের বিজয়—দৃঢ় সংকল্প ও অনুশীলন।


মানুষ তার মনকে নির্মাণ করতে পারে এবং সেটিকে যেমন চায় তেমন করে গড়ে তুলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে, মনের নির্মাণ করে চলেছি। আমাদের মধ্যে অধিকাংশই এই কাজটি অবচেতনভাবে করে থাকে, কিন্তু যারা বিষয়গুলোর তলে একটু গভীরভাবে নজর দিতে শিখেছে, তারা এই দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে এবং নিজেদের মানসিকতার সচেতন নির্মাতা হয়ে উঠেছে। তারা আর অন্যের প্রভাব বা পরামর্শের অধীন থাকে না, বরং নিজের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে। তারা “আমি”-র ঘোষণা দেয় এবং অধীনস্থ মানসিক শক্তিগুলোকে বাধ্য করে।


“আমি” হল মনের অধিপতি, এবং যেটিকে আমরা ইচ্ছাশক্তি বলি তা হল “আমি”-র যন্ত্র। অবশ্যই, এর পেছনে আরও কিছু রয়েছে—সার্বজনীন ইচ্ছাশক্তি ব্যক্তি ইচ্ছার চেয়ে উচ্চতর, কিন্তু ব্যক্তি ইচ্ছা সার্বজনীন ইচ্ছার সঙ্গে যতটা সংযুক্ত, তা সাধারণত বোঝা হয় না। যখন কেউ নিম্ন আত্মকে জয় করে “আমি”-কে প্রকাশ করে, তখন সে সার্বজনীন ইচ্ছার খুব ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে এবং তার অসাধারণ শক্তির অংশ হয়ে ওঠে। যেই মুহূর্তে কেউ “আমি”-র ঘোষণা দেয় এবং নিজেকে খুঁজে পায়, তখনই ব্যক্তি ইচ্ছা ও সার্বজনীন ইচ্ছার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপিত হয়।


কিন্তু সেই মহাশক্তির সদ্ব্যবহার করার পূর্বে, তাকে অবশ্যই প্রথমে নিম্ন আত্মের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে হবে।

ভাবুন, কী হাস্যকর ব্যাপার যে একজন মানুষ শক্তির প্রকাশ দাবি করে, অথচ সে তার নিজের মানসিক সত্তার নিচু অংশের দাস, যেগুলো আসলে অধীনস্থ থাকা উচিত। ভাবুন, একজন মানুষ তার মেজাজ, আসক্তি, প্রাণগত তৃষ্ণা ও নিম্নস্তরের প্রবৃত্তিগুলোর দাস, আর সে একইসঙ্গে ইচ্ছাশক্তির সুফল দাবি করছে! আমি এখানে ত্যাগ বা কঠোর বৈরাগ্যের কথা বলছি না, যা আমার দৃষ্টিতে দুর্বলতার স্বীকৃতি মাত্র। আমি বলছি আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কথা—অর্থাৎ নিজের মধ্যে “আমি”-র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।


উচ্চতর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, এই “আমি”-ই হল প্রকৃত আত্ম, আর বাকি সবই অ-আত্ম; তবে আমাদের এই আলোচনায় সে বিষয়ে বিস্তার করার সুযোগ নেই, তাই আমরা এখানে “আত্ম” শব্দটিকে সম্পূর্ণ মানুষ বোঝাতেই ব্যবহার করবো।


একজন মানুষ তার “আমি”-র পূর্ণ শক্তিতে প্রকাশ লাভ করার আগে তাকে তার নিম্ন আত্মের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব অর্জন করতে হবে। সবকিছুই তখনই কল্যাণকর যখন আমরা তাদের উপর কর্তৃত্ব রাখতে পারি; কিন্তু কোনো কিছুই কল্যাণকর নয় যদি তা আমাদের উপর কর্তৃত্ব করে। যতক্ষণ আমরা আত্মের নিম্নস্তরের অংশগুলোকে আমাদের নির্দেশ দিতে দিই, ততক্ষণ আমরা কেবল দাস। কেবল তখনই, যখন “আমি” তার সিংহাসনে আরোহন করে এবং রাজদণ্ড তোলে, তখনই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সবকিছু তাদের যথার্থ অবস্থানে ফিরে আসে।

আমরা যারা নিজেদের নিম্ন আত্ম দ্বারা চালিত হয়েছেন তাদের প্রতি কোনো দোষারোপ করছি না—তারা বিকাশের এক নিম্ন স্তরে রয়েছেন এবং সময়ের সাথে সাথে উন্নতি করবেন। কিন্তু আমরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যারা প্রস্তুত, তাদের এই সত্যের দিকে: রাজাকে অবশ্যই তার ইচ্ছাশক্তি প্রকাশ করতে হবে, এবং "প্রজাদের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে।" আদেশ দিতে হবে এবং তা কার্যকর করাতে হবে। বিদ্রোহ দমন করতে হবে, এবং যথার্থ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিতে হবে। আর এটি করার উপযুক্ত সময়—এখনই।


তুমি এতদিন ধরে তোমার বিদ্রোহী প্রজাদের তোমার সিংহাসন থেকে রাজারে সরিয়ে রাখতে দিচ্ছ। তুমি মানসিক রাজ্যকে দায়িত্বহীন ক্ষমতাগুলোর হাতে ভুলভাবে শাসিত হতে দিয়েছ। তুমি হয়ে উঠেছ ক্ষুধা, অপূর্ণ ভাবনা, উত্তেজনা ও নেতিবাচকতার দাস। ইচ্ছাশক্তিকে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং নিম্ন কামনা সিংহাসন দখল করেছে। এখন সময় এসেছে মানসিক রাজ্যে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার।


তুমি সক্ষম—তোমার ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে যে কোনো আবেগ, আসক্তি, কামনা বা চিন্তার শ্রেণির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পার। তুমি ভয়কে আদেশ দিতে পারো যেন সে পিছু হটে; ঈর্ষাকে তাড়িয়ে দিতে পারো; ঘৃণাকে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে পারো; রাগকে লুকিয়ে পড়তে বাধ্য করতে পারো; দুশ্চিন্তাকে থামিয়ে দিতে পারো; এবং বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করতে পারো অসংযত কামনা ও আসক্তিকে—তাদের প্রভু নয়, দাস করে তুলতে পারো—এই "আমি"-র দৃঢ় ঘোষণার মাধ্যমে।


তুমি নিজেকে সাহস, প্রেম এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের গৌরবময় সঙ্গতিতে পরিবেষ্টিত করতে পারো, একই উপায়ে। তুমি বিদ্রোহ দমন করে তোমার মানসিক রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারো—যদি তুমি কেবল আদেশ জারি করো এবং তা কার্যকর করাতে দৃঢ় থাকো। তুমি বাহিরের সাম্রাজ্যে অভিযান চালানোর আগে তোমার অভ্যন্তরীণ অবস্থা সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে—তোমার নিজের রাজ্য শাসনের ক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে। প্রথম যুদ্ধ হলো—সত্যিকারের আত্ম দ্বারা ক্ষুদ্র আত্মের বিজয়।

দৃঢ় ঘোষণা (Affirmation)

আমি আমার প্রকৃত আত্মের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছি।

এই কথাটি আন্তরিকভাবে ও দৃঢ়ভাবে দিনে অন্তত একবার করে, এবং বিশেষ করে সেই সময়গুলোতে পুনরাবৃত্তি করো যখন তুমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছো যা তোমাকে তোমার নিম্ন আত্মের পথ অনুসরণ করতে প্রলুব্ধ করে—যেখানে তোমার প্রকৃত আত্ম যে পথ নির্দেশ করে তা অনুসরণ করা উচিত। সন্দেহ ও দ্বিধার মুহূর্তে এই কথাটি আন্তরিকভাবে বলো, এবং তোমার পথ আপনাআপনি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

রাত্রিতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কয়েকবার এটি বলো, যখন তুমি শোবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছো। তবে খেয়াল রেখো—এই কথাগুলো যেন কেবল তোতাপাখির মতো মুখস্থ উচ্চারণ না হয়, বরং সেগুলিকে যে চিন্তা অনুপ্রাণিত করছে তা হৃদয়ে ধারণ করে বলো।

তোমার মনে এমন একটি চিত্র গঠন করো—প্রকৃত আত্ম তার নিম্ন স্তরের মানসিক গুণাবলির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে—রাজা তার সিংহাসনে বসেছে। তুমি অনুভব করবে এক নতুন ভাবনার প্রবাহ, এবং যেসব বিষয় এতদিন কঠিন বলে মনে হতো সেগুলো হঠাৎ করেই অনেক সহজ হয়ে যাবে। তুমি অনুভব করবে যে তুমি নিজেকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে এনেছো, এবং তুমি দাস নও, বরং প্রভু।

তুমি যেই ভাবনা ধারণ করছো, তা কর্মে রূপ নেবে, এবং ধীরে ধীরে তুমি সেই রূপ ধারণ করবে, যা তুমি তোমার মনে গড়ে তুলছো।


অনুশীলন (Exercise)

তোমার চেতনাকে দৃঢ়ভাবে উচ্চতর আত্মের উপর কেন্দ্রীভূত করো এবং যখন তুমি তোমার স্বভাবের নিম্ন দিকের টান অনুভব করো, তখন সেখান থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করো।

যখন তুমি রাগে ফেটে পড়তে যাচ্ছো—"আমি"-র ঘোষণা করো, এবং দেখবে তোমার কণ্ঠস্বর নেমে এসেছে। রাগ, বিকশিত আত্মের জন্য অযোগ্য।

যখন তুমি বিরক্ত বা খিটখিটে হয়ে পড়ো, তখন মনে করো তুমি আসলে কে—তোমার সত্তা কী—এবং সেই অনুভূতির উপরে উঠে দাঁড়াও।

যখন তুমি ভীত হয়ে পড়ো, মনে রেখো—প্রকৃত আত্ম কখনও ভয় পায় না, এবং সাহসকে প্রকাশ করো।

যখন তুমি ঈর্ষায় পুড়ে যাচ্ছো, তখন তোমার উচ্চতর সত্তার কথা ভাবো—আর হাসো।

এইভাবেই, প্রকৃত আত্মকে ঘোষণা করে, মনের নিম্ন স্তরের বিষয়গুলো যেন তোমাকে বিচলিত করতে না পারে তা নিশ্চিত করো। এই সব কিছু তোমার যোগ্য নয়—তাদের তাদের যথাযথ অবস্থানে ফেরাতে হবে।

তাদের যেন তোমার উপর আধিপত্য না বিস্তার করতে পারে—তারা যেন তোমার প্রজা হয়, প্রভু নয়।

তোমাকে এই নিম্ন স্তর থেকে উপরে উঠতে হবে, আর একমাত্র উপায় হল—এই চিন্তার ধারা থেকে নিজেকে মুক্ত করা, যারা এতদিন ধরে নিজেদের মতো করে সবকিছু চালিয়েছে।

শুরুর দিকে কিছুটা অসুবিধা হতে পারে, কিন্তু লেগে থাকলে তুমি সেই সন্তুষ্টি পাবে, যা কেবল আমাদের স্বভাবের নিম্ন অংশকে জয় করার মাধ্যমেই আসে।

তুমি অনেক দিন ধরে এক দাসের মতো জীবন কাটিয়েছো—এখন সময় এসেছে নিজেকে মুক্ত করার।

যদি তুমি এই অনুশীলনগুলো বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করো, তবে বছরের শেষে তুমি নিজেকে এক সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করবে এবং তোমার পূর্ববর্তী অবস্থার দিকে করুণার হাসি নিয়ে ফিরে তাকাবে।

কিন্তু মনে রেখো—এটি পরিশ্রমের কাজ। এটি কোনো খেলার বিষয় নয়, এটি একান্তভাবে আন্তরিক মানুষদের কাজ।

তুমি কি সেই প্রচেষ্টা করবে?


অধ্যায় ৫: ইচ্ছাশক্তির গোপন রহস্য

ইচ্ছাশক্তি এবং তা বিকাশ, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও পরিচালনার ক্ষমতা — প্রতিটি মানুষই সম্ভাব্যভাবে একটি দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অধিকারী — সর্বজনীন ইচ্ছাশক্তির মহান শক্তিঘর — ইচ্ছাশক্তির নয়, বরং মননের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন — মন একটি যন্ত্র — মানসিকভাবে অলস মানুষ — দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আসে প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে — অর্জনের মূল্য — প্রকৃত পরীক্ষা — ইচ্ছাশক্তি বিকাশের গোপন সূত্র — আত্ম-প্রস্তাবনা ও অনুশীলন।


যদিও মনোবিজ্ঞানীরা ইচ্ছাশক্তির প্রকৃতি নিয়ে নানা মত পোষণ করেন, তবে কেউই এর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন না, বা এর শক্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন না। প্রতিটি মানুষই দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির প্রভাব অনুভব করে — সবাই দেখে কিভাবে এটি ব্যবহার করে বৃহত্তম বাধা অতিক্রম করা যায়। কিন্তু খুব কম মানুষই বোঝে যে ইচ্ছাশক্তি বুদ্ধিদীপ্ত অনুশীলনের মাধ্যমে বিকশিত ও শক্তিশালী করা যায়। তারা মনে করে, যদি তাদের একটি দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকতো, তবে তারা বিস্ময়কর কিছু অর্জন করতে পারত; কিন্তু সেই ইচ্ছাশক্তি গঠনের চেষ্টার পরিবর্তে তারা নিষ্ফল আক্ষেপেই সন্তুষ্ট থাকে। তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিন্তু কিছু করে না।


যারা এই বিষয়টি গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছেন, তারা জানেন যে ইচ্ছাশক্তি—তার সব সুপ্ত সম্ভাবনা এবং বিশাল শক্তিসম্পন্ন অবস্থাসহ—বিকাশ, শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা যায়, ঠিক যেমন প্রকৃতির অন্য যেকোনো শক্তিকে। তুমি ইচ্ছাশক্তির প্রকৃতি সম্পর্কে যাই ধারণা করো না কেন, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চর্চা করলে তুমি ফল পাবে।


ব্যক্তিগতভাবে, আমার ইচ্ছাশক্তি সম্পর্কে একটি একটু ভিন্নতর ধারণা আছে। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সম্ভাব্যভাবে একটি শক্তিশালী ইচ্ছাশক্তি রয়েছে, এবং যা তাকে করতে হবে তা হলো—তার মনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সেই ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করার উপযোগী করে তোলা। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের মনের উচ্চ স্তরে একটি বিশাল ইচ্ছাশক্তির ভাণ্ডার অপেক্ষা করছে তার ব্যবহারের জন্য। ইচ্ছাশক্তির প্রবাহ সেই মানসিক তারের মধ্য দিয়ে ছুটে চলছে, আর যা করতে হবে তা হলো—মনের ট্রলি-পোলটি তুলে ধরা এবং সেই শক্তিকে নিজের কাজে নামিয়ে আনা। আর এই শক্তির জোগান অফুরন্ত, কারণ তোমার ছোট্ট স্টোরেজ ব্যাটারি সংযুক্ত রয়েছে সর্বজনীন ইচ্ছাশক্তির মহান বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে, যার শক্তি অনন্ত ও অশেষ।


তোমার ইচ্ছাশক্তির নয়, বরং তোমার মনেরই প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। মন হলো সেই যন্ত্র, যার মাধ্যমে ইচ্ছাশক্তি প্রকাশ পায়, এবং ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ তার উপর নির্ভর করে, যন্ত্রটি কতটা সূক্ষ্ম ও উন্নত। তবে তুমি চাইলে আমার এই তত্ত্ব গ্রহণ না-ও করতে পারো। এই পাঠ—তোমার তত্ত্ব হোক বা আমার—দু'টির সঙ্গেই মানিয়ে যাবে।


সে ব্যক্তি, যে নিজের মনকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে যাতে ইচ্ছাশক্তি তার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে, সে নিজের জন্য এক বিস্ময়কর সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে।

সে কেবলমাত্র একটি মহান শক্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়েছে তাই নয়, বরং এমনসব ক্ষমতা, প্রতিভা ও যোগ্যতাও ব্যবহার করতে পেরেছে, যেগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে তার আগে কোনো ধারণাই ছিল না। ইচ্ছাশক্তির এই গোপন রহস্যই হল সেই জাদুকরী চাবি, যা সব দরজা খুলে দেয়।


প্রয়াত ডোনাল্ড জি. মিচেল একবার লিখেছিলেন:

"সংকল্পই মানুষকে প্রকাশ করে তোলে; কেবল দুর্বল সংকল্প নয়, বরং সেই অনমনীয়, অপরাজেয় সংকল্প; লক্ষ্যচ্যুত উদ্দেশ্য নয়—বরং সেই দৃঢ় ও অবিচল ইচ্ছাশক্তি, যা বাধা ও বিপদকে পদদলিত করে সামনে এগিয়ে চলে, যেমন এক কিশোর শীতের সকালে জমে ওঠা তুষার-ভূমির ওপর হেঁটে চলে যায়; যা তার চোখ ও মস্তিষ্কে অনাবিল গর্ব ও স্পন্দনের অনুভূতি জাগায়, এমনকি অসম্ভবের দিকেও। ইচ্ছাশক্তিই মানুষকে দৈত্যসম মহৎ করে তোলে।”


আমাদের অনেকেই অনুভব করি, যদি আমরা ইচ্ছাশক্তিকে সত্যিই প্রয়োগ করতাম, তাহলে বিস্ময়কর কিছু করতে পারতাম। কিন্তু কোনওভাবে আমরা সেই পরিশ্রমটুকু করতে চাই না—অন্তত, আমরা কখনোই সত্যিকারের “ইচ্ছা প্রকাশ”-এর সেই স্তরে পৌঁছাই না। আমরা বারবার তা পিছিয়ে দিই, বলি “একদিন করব,” কিন্তু সেই “একদিন” আর আসে না।


আমরা সহজাতভাবে ইচ্ছাশক্তির শক্তি অনুভব করি, কিন্তু আমাদের মধ্যে সে শক্তি প্রয়োগ করার মতো যথেষ্ট প্রাণশক্তি নেই, ফলে আমরা জোয়ারের স্রোতের মতো ভেসে চলি। তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু বন্ধুবান্ধব বাধা এসে পড়ে, এমন কিছু উপকারী প্রতিবন্ধকতা সামনে আসে, বা এমন কোনো দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হয়, যা আমাদের জাগিয়ে তোলে, এবং বাধ্য করে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে—আর সেই মুহূর্ত থেকেই আমরা কিছু একটা করা শুরু করি।


আমাদের সমস্যাটা হলো: আমরা যেটা করতে চাই, সেটা করতে চাওয়ার শক্তিটুকু নেই। আমাদের তা “খুব বেশি করে” করতে ইচ্ছা করে না। আমরা মানসিকভাবে অলস, এবং আমাদের আকাঙ্ক্ষা দুর্বল। যদি তুমি “আকাঙ্ক্ষা” শব্দটি পছন্দ না করো, তাহলে তার বদলে “আকাঙ্ক্ষা” শব্দের পরিবর্তে “আদর্শচেতনা” বা “আদর্শপ্রয়াস” (Aspiration) ব্যবহার করতে পারো। (অনেকে নীচু মানসিক প্রবৃত্তিকে "Desire" এবং উচ্চতর মানসিক তাগিদকে "Aspiration" বলে—সবই শব্দের খেলা, তুমি যেটা পছন্দ করো সেটা নাও)। এটাই আসল সমস্যা।


একজন মানুষ যদি তার প্রাণ হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে, বা একজন নারী যদি তার প্রিয়তমকে হারানোর আশঙ্কায় পড়ে, তখন তুমি এমন এক ইচ্ছাশক্তির বিস্ফোরণ দেখতে পাবে, যা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। যদি একটি নারীর সন্তান বিপদের সম্মুখীন হয়, তবে তুমি দেখবে এমন এক সাহস ও ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ, যা সমস্ত বাধাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। অথচ সেই একই নারী হয়তো এক কর্তৃত্বপরায়ণ স্বামীর সামনে ভীত হয়ে পড়ে, কিংবা একটি সহজ কাজ করার ইচ্ছাও হারিয়ে ফেলে।


একটি ছেলে যদি কোনো কাজকে খেলা মনে করে, তাহলে সে সমস্ত কাজ করে ফেলতে পারে; অথচ তাকে যদি সামান্য কিছু কাঠ কাটতে বলা হয়, তখন সে কিছুতেই নিজেকে তা করতে বাধ্য করতে পারে না।


প্রবল ইচ্ছাশক্তি আসে প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে। যদি তুমি সত্যিই কোনও কিছু করতে প্রবলভাবে চাও, তবে সাধারণত তুমি সেই কাজ করার মতো ইচ্ছাশক্তিও গড়ে তুলতে পারো।


তোমার সমস্যাটা এই যে, তুমি সত্যিই এই কাজগুলো করতে চাওনি—তবু দোষ দিচ্ছো তোমার ইচ্ছাশক্তিকে।

তুমি বলো যে তুমি কাজটা করতে চাও, কিন্তু যদি একটু ভেবে দেখো, তাহলে বুঝবে, আসলে তুমি অন্য কিছু আরেকটু বেশি করে চাও ওই কাজটার চেয়ে। তুমি সাফল্যের মূল্য চুকাতে রাজি নও।

একটু থামো, এই কথাগুলোর বিশ্লেষণ করো, আর নিজের জীবনের প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করে দেখো।


তুমি মানসিকভাবে অলস—এইটাই আসল সমস্যা।

আমার সামনে এসে একথা বলো না যে, তোমার যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি নেই। তোমার ভেতরে প্রচুর ইচ্ছাশক্তি মজুত রয়েছে, কেবল তুমি সেটা ব্যবহার করার মতো উৎসাহ বা পরিশ্রমে আগ্রহী নও।

তুমি যদি সত্যিই এই বিষয়টি নিয়ে আন্তরিক হও, তাহলে এখনই কাজে নেমে পড়ো।

প্রথমেই খুঁজে বার করো তুমি সত্যিই কী করতে চাও—তারপর সেই কাজ করতে শুরু করো।


ইচ্ছাশক্তি নিয়ে এখন ভাবতে যেও না—যখন দরকার পড়বে, তখন তুমি তার পুরো সরবরাহ পেয়ে যাবে।

মূল কাজ হলো এমন একটা জায়গায় পৌঁছানো, যেখানে তুমি সংকল্প করবে—তুমি “ইচ্ছা প্রকাশ করবে যে তুমি ইচ্ছা করবে”।

এটাই আসল পরীক্ষা—সংকল্প করা।

এই কথাগুলো নিয়ে একটু ভাবো, আর নিজের মনে স্থির করো, তুমি সত্যিই কি এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তুমি নিজেকে “ইচ্ছাকামী” বানাতে প্রস্তুত? তুমি কি সত্যিই প্রস্তুত পরিশ্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য?


এই বিষয় নিয়ে বহু চমৎকার প্রবন্ধ ও বই লেখা হয়েছে, সবগুলোতেই ইচ্ছাশক্তির মাহাত্ম্য নিয়ে প্রবল উৎসাহ ও প্রশংসা প্রকাশ পেয়েছে; কিন্তু খুব কম লেখকই বলেছেন, কীভাবে এই শক্তি অর্জন করা যায়, বিশেষ করে তাদের জন্য যাদের মধ্যে এই শক্তি নেই, বা খুব সীমিত মাত্রায় রয়েছে।


কিছু লেখক কিছু ব্যায়াম বা চর্চা দিয়েছেন, যেগুলো নাকি ইচ্ছাশক্তিকে “শক্তিশালী” করে তোলে—কিন্তু বাস্তবে এই ব্যায়ামগুলো মানসিক সক্ষমতাকেই বৃদ্ধি করে, যাতে মন নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা শক্তির ভাণ্ডার থেকে শক্তি আহরণ করতে পারে।

কিন্তু তাঁরা প্রায়শই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উপেক্ষা করেছেন, সেটি হলো—নিজেকে নিজেই প্রভাবিত করার (auto-suggestion) ভেতরেই নিহিত আছে মনের বিকাশের রহস্য, যাতে করে মন ইচ্ছাশক্তির একজন দক্ষ বাহক হয়ে উঠতে পারে।


স্ব-প্রেরণা (Auto-Suggestion)

আমি আমার ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করছি।

এই কথাগুলি এখনই একাধিকবার আন্তরিক ও দৃঢ়ভাবে বলো, এই লেখাটি পড়া শেষ করার পর। তারপর সারা দিনে বহুবার এটি মনে মনে বলো—কমপক্ষে প্রতি ঘণ্টায় একবার। বিশেষ করে এমন সময় বলো, যখন এমন কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছো, যেখানে তোমার ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার দরকার।

রাত্রে শোয়ার আগে একাধিকবার পুনরাবৃত্তি করো।


তবে মনে রেখো—এই কথাগুলোর নিজের মধ্যে কোনও জাদু নেই, যদি না তুমি এদের সঙ্গে গভীর চিন্তা ও বিশ্বাস জুড়ে দাও।

বাস্তবে, চিন্তাটাই আসল কথা—আর এই কথাগুলো শুধু ভাবনাগুলো ঝুলিয়ে রাখার জন্য কিছু খুঁটির মতো।

তাই তুমি যা বলছো, সেটা অনুভব করো, মানো, এবং ভেতর থেকে বিশ্বাস করো।


প্রথমে তোমার বিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে হবে—এই শব্দগুলো ব্যবহার করতে হবে এমন এক প্রত্যাশা নিয়ে, যে এতে ফল আসবেই।

মনকে এই চিন্তায় স্থির রাখো যে তুমি তোমার ভেতরের ইচ্ছাশক্তির ভাণ্ডার থেকে শক্তি আহরণ করছো।

এভাবে ভাবতে ভাবতে খুব তাড়াতাড়ি তুমি দেখতে পাবে, এই চিন্তাই ক্রিয়ায় রূপ নিচ্ছে, আর তোমার ইচ্ছাশক্তি নিজেকে প্রকাশ করছে।


প্রতিবার এই শব্দ বলার সঙ্গে সঙ্গে তুমি একধরনের নবীন শক্তি অনুভব করবে।

তুমি দেখতে পাবে—তুমি বাধা কাটিয়ে উঠতে পারছো, খারাপ অভ্যাসগুলো ছেড়ে দিতে পারছো, আর আশ্চর্য হয়ে যাবে, কীভাবে সমস্যাগুলো একে একে সহজ হয়ে যাচ্ছে।



---


ব্যায়াম (Exercise):

প্রতিদিন অন্তত একটি অপছন্দের কাজ করো, এক মাস ধরে।

যদি কোনও নির্দিষ্ট কাজ থেকে তুমি বারবার পালাতে চাও, তাহলে ঠিক সেটাই করো।

এই ব্যায়াম তোমাকে আত্মত্যাগ বা বিনয় শেখানোর জন্য নয়—তোমার ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য।


প্রতিটি আনন্দের কাজ যে কেউ আনন্দের সঙ্গেই করতে পারে, কিন্তু অপছন্দের কাজকে আনন্দের মনোভাবে করা—এইটাতেই ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার ঘটে।

আর এই ভাবেই তোমার চরিত্র গঠনের একটা দুর্দান্ত অনুশীলন হবে।


এক মাস চেষ্টা করো—তাহলে নিজেই বুঝতে পারবে এর আসল গুরুত্ব কোথায়।

আর যদি এই অনুশীলন থেকে পিছু হটো, তাহলে এখনই স্বীকার করে নাও যে তুমি ইচ্ছাশক্তি গড়ে তুলতে চাও না, এবং যেভাবে আছো, দুর্বল হিসেবেই থাকতে চাও।



অধ্যায় ৬: কিভাবে ক্ষতিকারক চিন্তার আকর্ষণ থেকে অজেয় হওয়া যায়

প্রথম কাজ—ভয়ের চিন্তা—দৃঢ় প্রত্যাশা এক শক্তিশালী চুম্বক—ভীত মানুষ—ভয়ের অভ্যাস কাটিয়ে ওঠা—নেতিবাচক চিন্তার সঙ্গে যুদ্ধ করে সময় নষ্ট না করা—সঠিক মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি—নতুন কম্পন সৃষ্টি—ভয় জয়ের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ—ইতিবাচক শক্তির বিজয়।


প্রথম কাজটি হলো—ভয় ও চিন্তার দুশ্চিন্তা দূর করে ফেলা।

ভয়ের চিন্তা (Fear-thought) বহু দুঃখ ও ব্যর্থতার মূল কারণ।

তোমাকে এই কথা বহুবার বলা হয়েছে—তবুও, এটি বারবার বলার মতোই একটি বিষয়।

ভয় হচ্ছে মনমাঝারি একটা অভ্যাস, যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দীর্ঘদিনের নেতিবাচক জাতিগত চিন্তার (negative race-thought) মাধ্যমে—

কিন্তু একান্ত ব্যক্তি প্রচেষ্টা ও দৃঢ়তার মাধ্যমে আমরা এই অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে পারি।


দৃঢ় প্রত্যাশা একটি অত্যন্ত শক্তিশালী চুম্বকের মতো।

যে মানুষ গভীর আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে কিছু চায়—

যদি সে তা আশা করে বিশ্বাসভরে, শান্তভাবে, আত্মস্থভাবে—

তবে এমন সব মানুষ, বস্তু, পরিস্থিতি ও পরিবেশ তার দিকে আকৃষ্ট হয়, যা তাকে সাহায্য করতে সবচেয়ে উপযুক্ত।


আবার ঠিক তেমনি—

যে মানুষ কোনও কিছুকে ভয় পায়,

সে এমন সব শক্তিকে ক্রিয়াশীল করে ফেলে, যা তাকে সেই ভয়ংকর ঘটনার মুখোমুখি করে তোলে।


দেখো, ভীত ব্যক্তি আসলে মনে মনে সেই ঘটনাকেই প্রত্যাশা করে,

আর সৃষ্টির নিয়ম (Law of Attraction)-এর দৃষ্টিতে তা একেবারেই সমান, যেন সে সেই জিনিসটা চেয়েছে বা কামনা করেছে।

এই নিয়ম উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করে—তত্ত্ব একটাই।


ভয়ের অভ্যাস কাটানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো—

মনকে সাহসী করে তোলা।

একইভাবে যেমন, অন্ধকার সরানোর সহজ উপায় হলো আলো জ্বালানো।


নেতিবাচক চিন্তার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করা, তার শক্তিকে স্বীকার করে, তাকে "না" বলার চেষ্টা করা—এটা শুধু সময়ের অপচয়।

সবচেয়ে ভালো, নির্ভরযোগ্য, সহজ ও দ্রুত উপায় হলো—

যে ইতিবাচক চিন্তা তুমি চাও, সেটাকে নিজের মধ্যে ধরে রাখা।

এবং ক্রমাগত তার ওপর মনোযোগ রেখে তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া।


তাই, "আমি ভয় পাচ্ছি না" না বলে বরং বলো:

"আমি সাহসে পূর্ণ", "আমি সাহসী।"


তুমি বলতে পারো, "ভয় পাওয়ার কিছু নেই।"

এটি একটি নাকচের মতো হলেও, এখানে মূলত ভয়ের বস্তু বা পরিস্থিতিকে অস্বীকার করা হচ্ছে,

না যে তুমি ভয় পেয়েছো আর এখন সেটা কাটানোর চেষ্টা করছো।


ভয় কাটিয়ে উঠতে হলে,

একজন মানুষকে সাহসের মানসিক অবস্থানে দৃঢ়ভাবে স্থির থাকতে হবে।

তাকে সাহসের কথা ভাবতে হবে, সাহসের কথা বলতে হবে, সাহসের মতো কাজ করতে হবে।

মনজুড়ে সর্বদা সাহসের একটি চিত্র ধরে রাখতে হবে—

যতক্ষণ না তা তার স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা হয়ে ওঠে।

এই আদর্শকে মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো,

তবে ধীরে ধীরে তুমি তার স্তরে পৌঁছে যাবে—এই আদর্শ বাস্তব রূপ পাবে।


“সাহস” শব্দটিকে গভীরভাবে মনের মধ্যে প্রবেশ করতে দাও,

তারপর সেখানে শক্ত করে ধরে রাখো যতক্ষণ না মন সেটিকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করে।

নিজেকে একজন সাহসী ব্যক্তি হিসেবে ভাবো,

চিন্তায় দেখো তুমি কিভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে সাহসের সঙ্গে কাজ করছো।

এই সত্যটা বুঝে নাও যে,

ভয় পাওয়ার কিছু নেই—চিন্তা ও ভয় কখনো কাউকে সাহায্য করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।

ভয় চেষ্টাকে স্তব্ধ করে দেয়, আর সাহস ক্রিয়াকে উজ্জীবিত করে।


যে আত্মবিশ্বাসী, নির্ভীক, আশাবাদী এবং “আমি পারি এবং আমি করব” মনোভাবের অধিকারী—

সে একজন অসাধারণ চুম্বক।

তার দিকে ঠিক সেই জিনিসগুলো আকৃষ্ট হয়, যা তার সাফল্যের জন্য প্রয়োজন।

সবকিছু যেন তার পথেই চলে আসে,

আর লোকেরা বলে, “ভাগ্য ভালো!”

ধুর! এতে ভাগ্যের কিছু নেই—সবকিছুই মনের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।

আর "আমি পারি না" বা "আমি ভয় পাচ্ছি" ধরনের মানসিক অবস্থাও ঠিক ততটাই তার ভাগ্য নির্ধারণ করে।


এতে কোনো রহস্য নেই।

তুমি চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবে আমি যা বলেছি তা কতটা সত্য।

তুমি কি কখনো এমন একজন সফল মানুষকে দেখেছো,

যার মধ্যে “আমি পারি এবং আমি করব” এই ভাবনা দৃঢ়ভাবে ছিল না?

সে "আমি পারি না" টাইপ মানুষের চারপাশ দিয়ে হাঁটে চলে যায়—

যদিও ওই “আমি পারি না” মানুষটার হয়তো আরও বেশি যোগ্যতা ছিল।


এই প্রথম মানসিক অবস্থাই ভিতরের সুপ্ত গুণগুলোকে জাগিয়ে তোলে,

এবং বাইরের থেকে সাহায্য আকৃষ্ট করে;

আর দ্বিতীয় মনোভাব কেবল ব্যর্থতা ও “আমি পারি না” টাইপ মানুষ ও পরিস্থিতিকেই টেনে আনে,

এবং ব্যক্তির নিজের শক্তিগুলোকে ফুটে উঠতে বাধা দেয়।


আমি নিজে এই কথাগুলোর সত্যতা প্রমাণ করেছি—আর অনেকেই করেছে,

আর এই সত্য জানে এমন মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।


তোমার চিন্তার শক্তিকে নষ্ট কোরো না—বরং তা কাজে লাগাও।

ব্যর্থতা, দুঃখ, বিশৃঙ্খলা, দুঃখ-কষ্ট আকৃষ্ট করা বন্ধ করো।

এখন থেকেই শুরু করো—উজ্জ্বল, ইতিবাচক, আনন্দময় ভাবনা ছড়াও চারদিকে।


তোমার প্রধান চিন্তা হোক: “আমি পারি এবং আমি করব।”

ভাবো “আমি পারি এবং আমি করব।”

স্বপ্ন দেখো “আমি পারি এবং আমি করব।”

বলো “আমি পারি এবং আমি করব।”

কাজ করো এই বিশ্বাস নিয়ে: “আমি পারি এবং আমি করব।”


“আমি পারি এবং আমি করব” এই স্তরে বাঁচো—

তবে তুমি অনুভব করবে নতুন এক কম্পনের প্রকাশ,

দেখবে তার ফলাফল—

বুঝতে পারবে, তোমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে—

আর অনুভব করবে, যা তোমার, তা-ই তোমার দিকে আসছে।


তুমি আরও ভালো বোধ করবে, আরও ভালো কাজ করবে, আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবে,

আর প্রতিটি দিক থেকে আরও ভালো হয়ে উঠবে—

যেদিন তুমি “আমি পারি এবং আমি করব” দলের একজন হয়ে পড়ো।


ভয়ই চিন্তার মাদার (অভিশাপ)


ভয়ই উদ্বেগ, ঘৃণা, ঈর্ষা, কুৎসা, ক্রোধ, অস্বস্তি, ব্যর্থতা এবং সব অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতির মূল। যে ব্যক্তি ভয় থেকে মুক্ত হবে, সে দেখতে পাবে বাকি সব দানবেরা নিজে থেকেই চলে গেছে। মুক্তির একমাত্র উপায় হল ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া। এর মূলকে মুছে ফেলো। আমি মনে করি, ভয় জয় করা হল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সেই সকল লোকদের জন্য, যারা চিন্তা শক্তির প্রয়োগ শিখতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত ভয় তোমাকে দমন করে রাখে, ততক্ষণ তুমি চিন্তার জগতে অগ্রগতি করতে পারবে না, এবং আমি জোর দিয়ে বলব, তোমাকে এই বাধাটি একেবারে সরিয়ে ফেলার জন্য কাজ শুরু করতে হবে। তুমি এটা করতে পারো—শুধু যদি তুমি সত্যিই এটি করার জন্য মনস্থির করো। আর একবার তুমি ভয় থেকে মুক্তি পেলে, জীবন তোমার কাছে পুরোপুরি অন্যরকম হয়ে উঠবে—তুমি অনেক সুখী, মুক্ত, শক্তিশালী, আরও ইতিবাচক অনুভব করবে এবং জীবনের প্রতিটি উদ্যোগে অনেক বেশি সফল হবে।


আজই শুরু করো, মনস্থির করো যে এই অনুপ্রবেশকারীকে বিদায় দিতে হবে—তার সাথে কোনো আপস না করে, তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ দাবি করো। প্রথমদিকে কাজটি কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু প্রতিবার তুমি তাকে প্রতিরোধ করবে, সে দুর্বল হয়ে যাবে, আর তুমি শক্তিশালী হবে। তার পুষ্টি বন্ধ করে দাও—তাকে মেরে ফেলো—সে ভয়হীন চিন্তার পরিবেশে বাঁচতে পারে না। সুতরাং, এখনই ভালো, শক্তিশালী, ভয়হীন চিন্তা দিয়ে তোমার মন পূর্ণ করতে শুরু করো—নিজেকে ভয়হীন চিন্তা করতে ব্যস্ত রাখো, এবং ভয় নিজেই মারা যাবে। ভয়হীনতা ইতিবাচক—ভয় নেতিবাচক, এবং তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো যে ইতিবাচকটাই জয়ী হবে।


যতক্ষণ পর্যন্ত ভয় তার "কিন্তু", "যদি", "ধরি", "আমি afraid", "আমি পারব না", "কি হবে যদি" এবং তার সমস্ত কাপুরুষের প্রস্তাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার চিন্তা শক্তিকে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। একবার তাকে পথ থেকে সরিয়ে ফেললে, তোমার জন্য পথ একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে, এবং তোমার চিন্তার পাল্লা প্রতিটি দিকে বাতাস ধরবে। সে একটি "জোনাহ"। তাকে ফেলে দাও! (যে তিমি তাকে গিলে ফেলবে, তার জন্য আমার সমবেদনা থাকবে।)


আমি পরামর্শ দেব, তুমি এমন কিছু কাজ শুরু করো, যা তুমি অনুভব করো তুমি করতে পারবে যদি তুমি ভয়কে অতিক্রম করতে পারো। কাজ শুরু করো এগুলি করার জন্য, প্রতিটি পদক্ষেপে "সাহস" ঘোষণা করো, এবং তুমি অবাক হয়ে যাবে দেখতে, কিভাবে পরিবর্তিত মানসিক অবস্থা তোমার পথ থেকে বাধাগুলো সরিয়ে দেবে, এবং পরিস্থিতি অনেক সহজ হয়ে উঠবে, যা তুমি পূর্বে অনুমানও করতে পারনি। এমন ধরনের অনুশীলন তোমাকে অসাধারণভাবে উন্নতি করতে সাহায্য করবে, এবং তুমি এইভাবে কিছু অনুশীলন করার ফলস্বরূপ অনেক সন্তুষ্ট হবে।

তোমার সামনে অনেক কাজ অপেক্ষা করছে সম্পাদনের জন্য, যেগুলো তুমি সহজেই আয়ত্তে আনতে পারো—শুধু যদি তুমি ভয়ের জোয়াল ফেলে দিতে পারো—যদি তুমি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত সেই ভয়াবহ ভাবনার প্রভাব স্বীকার না করো, এবং নির্ভয়ে তোমার নিজের "আমি" এবং তার শক্তিকে ঘোষণা করো।


আর ভয়কে পরাজিত করার সেরা উপায় হল “সাহস” ঘোষণা করা এবং ভয়ের কথা ভাবা বন্ধ করা। এই পদ্ধতিতে তুমি তোমার মনকে নতুন চিন্তার অভ্যাসে অভ্যস্ত করে তুলবে, যার ফলে পুরোনো নেতিবাচক চিন্তাগুলো মুছে যাবে—যেগুলো এতদিন তোমাকে টেনে ধরছিল আর পিছিয়ে রাখছিল।


"সাহস" শব্দটিকে তোমার সঙ্গী করে নাও, এবং তা তোমার কাজে প্রকাশ করো।


মনে রেখো, ভয় করার মতো একমাত্র জিনিস হল—ভয় নিজেই। কিন্তু—না, এমনকি ভয়কেও ভয় পেও না, কারণ সে তো আসলে একজন কাপুরুষ, যে সাহসের মুখোমুখি হলেই পালিয়ে যায়।


অধ্যায় ৭: নেতিবাচক চিন্তার রূপান্তর


ভয় হলো চিন্তার মূল—আর চিন্তার সন্তান হলো উদ্বেগ। যদি তুমি ভয়কে নির্মূল করো, উদ্বেগও খাদ্যের অভাবে মারা যাবে। এই উপদেশটি খুবই পুরনো, তবু তা বারবার বলার যোগ্য, কারণ আমরা এই শিক্ষাটির বিশেষ প্রয়োজন বোধ করি। কিছু মানুষ মনে করে যে যদি আমরা উদ্বেগ ও ভয় দূর করে ফেলি, তবে জীবনের কোনো বড় কাজ আর সাধন করা যাবে না। আমি এমন সম্পাদকীয় পড়েছি বিখ্যাত পত্রপত্রিকায়, যেখানে লেখকরা বলেছে যে উদ্বেগ না থাকলে জীবনের গুরুতর কাজ করা সম্ভব নয়, কারণ উদ্বেগই নাকি আগ্রহ ও কাজের উদ্দীপনা জোগায়। এটি পুরোপুরি অর্থহীন কথা—যেই বলুক না কেন।


উদ্বেগ কখনোই কোনো কাজের সাধনে সাহায্য করেনি; বরং তা সাধনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যে বস্তুর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, তার পেছনে কাজ করে আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহ—এই দুই হলো কর্মপ্রেরণার মূল চালিকা শক্তি। যদি কেউ সত্যিই কোনো কিছুকে আকাঙ্ক্ষা করে, তবে সে স্বাভাবিকভাবেই তার সাধনের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে এবং যেকোনো সম্ভাব্য সাহায্যকে আঁকড়ে ধরতে প্রস্তুত থাকে।


এমনকি, তার অবচেতন মনও সক্রিয় হয়ে ওঠে, এবং তার চেতনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ও ধারণা উদিত হতে শুরু করে। আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহই হলো সফলতার মূল উপাদান। উদ্বেগ আকাঙ্ক্ষা নয়।


যখন কারো পারিপার্শ্বিক অবস্থা অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন সে হয়তো বাধ্য হয়ে এমন কিছু করে ফেলে যা তার সেই অবস্থাকে পালটে দেয়—কিন্তু এটাও আসলে আকাঙ্ক্ষারই রূপ। মানুষ চায় সে অবস্থার পরিবর্তন, এবং যখন সেই চাওয়া তীব্র হয়ে ওঠে, তখন সে সমস্ত আগ্রহ ও মনোযোগ ঐ পরিবর্তনের কাজের পেছনে নিবদ্ধ করে এবং প্রবল প্রচেষ্টায় সফলতা লাভ করে।


কিন্তু এটা উদ্বেগের কারণে হয় না। উদ্বেগ তো শুধু হাত কচলায় আর বলে, “আমার সর্বনাশ,” এবং তার স্নায়ুগুলোকে নিঃশেষ করে ফেলে, কিন্তু কিছুই করে না। আকাঙ্ক্ষা এর ঠিক বিপরীত পথে কাজ করে। যখন পরিস্থিতি সহ্য করার অযোগ্য হয়ে ওঠে, তখন সে বলে, “আমি আর এটা সহ্য করব না—আমি একটা পরিবর্তন আনব।” আর তখনই আকাঙ্ক্ষা কর্মে রূপান্তরিত হয়।


মানুষ তখন চরমভাবে সেই পরিবর্তন চায় (আর এই চাওয়াটাই হলো সবচেয়ে কার্যকর উপায়) এবং তার আগ্রহ ও মনোযোগ যখন সেই কাজের পেছনে নিবদ্ধ হয়, তখন সে বাস্তবেই পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে। উদ্বেগ কোনো কিছু অর্জনে সাহায্য করে না—উদ্বেগ নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাশা ইতিবাচক এবং জীবনদায়ী। কেউ উদ্বেগে ভুগে নিজেকে ধ্বংস করতে পারে, কিন্তু কিছুই অর্জিত হয় না। অথচ সেই একই উদ্বেগ ও অসন্তোষকে যদি আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহে রূপান্তর করে, আর সেই সঙ্গে বিশ্বাস রাখে যে সে পরিবর্তন আনতে পারবে—অর্থাৎ “আমি পারব এবং করব” মনোভাব ধারণ করে—তবে কিছু একটা ঘটে।


চাওয়াটাকে কর্মে পরিণত করো, উদ্বেগকে রূপান্তর করো সজীব আকাঙ্ক্ষায়—তাহলেই জীবন বদলে যাবে।


হ্যাঁ, ভয় ও উদ্বেগকে বিদায় জানাতে হবে—তবেই আমরা কিছু করতে পারি।

এই নেতিবাচক অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করে আমাদের জায়গা করে নিতে হবে আত্মবিশ্বাস ও আশার জন্য। উদ্বেগকে রূপান্তর করো তীব্র আকাঙ্ক্ষায়—তখন দেখবে আগ্রহ জেগে উঠছে, এবং তুমি ভাবতে শুরু করবে এমনসব চিন্তা, যা তোমার কাছে অর্থবহ।


তোমার মনের গভীরে জমা থাকা ভাবনার বিপুল ভাণ্ডার থেকে চিন্তা আসতে শুরু করবে এবং তুমি সেগুলিকে কর্মে প্রকাশ করতে পারবে। আরও ভালো কথা, তখন তুমি তোমার চারপাশের জগতের সেই সকল ভাবনার সাথেও সাযুজ্য স্থাপন করবে, যেগুলি একই প্রকৃতির—এবং তুমি সেই চিন্তাধারার ঢেউয়ের মধ্য থেকে সাহায্য ও সহায়তাও আকর্ষণ করতে পারবে।


মানুষ নিজের মনে যে ভাব ধরে রাখে, সেই ভাবের প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ চিন্তার তরঙ্গ নিজের দিকে টেনে আনে—এটাই তার মানসিক অবস্থান।


এরপর শুরু হয় আকর্ষণের মহাবিধানের কার্যক্রম—এই আইন অনুযায়ী তুমি এমন লোকদের নিজের দিকে আকর্ষণ করবে যারা তোমাকে সাহায্য করতে পারে, এবং তুমি নিজেও আকৃষ্ট হবে তাদের প্রতি যারা তোমার সাহায্য করতে সক্ষম। এই "আকর্ষণের আইন" কোনো কল্পকাহিনি নয়, কোনো অতিপ্রাকৃত ভ্রান্ত ধারণা নয়—এটি প্রকৃতির এক জীবন্ত, কার্যকর বিধান, যা তুমি নিজে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুঝে নিতে পারো।


কোনো কিছুতে সফল হতে চাইলে, তোমাকে সেটা গভীরভাবে চাইতে হবে—আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে প্রকট ও স্পষ্টভাবে। যার আকাঙ্ক্ষা দুর্বল, তার দিকে সামান্যই কিছু আকৃষ্ট হয়। আকাঙ্ক্ষা যত প্রবল, তত বেশি শক্তি উদ্দীপ্ত হয়।


তুমি যদি সত্যিই কিছু পেতে চাও, তবে তা চাইতে হবে মনেপ্রাণে। তুমি সেটা চাইবে তোমার চারপাশের অন্যান্য সবকিছুর চেয়ে বেশি, এবং সেই চাওয়ার জন্য যা প্রয়োজন, সেই মূল্য দিতেও প্রস্তুত থাকতে হবে।


এই মূল্য অনেক সময় হতে পারে আরাম, অবকাশ, বিনোদন বা আরও অনেক কিছু—সবসময় না হলেও প্রায়ই। এটা নির্ভর করে তুমি কী চাও তার ওপর। সাধারণ নিয়ম হলো, তুমি যত বড় কিছু চাও, তার জন্য তত বড় মূল্য দিতে হয়। প্রকৃতি চায় যথাযথ বিনিময়।


কিন্তু যদি তুমি সত্যিকারের আন্তরিক চাওয়ার আগুনে পুড়তে থাকো, তাহলে সেই মূল্য দেওয়া তোমার কাছে তুচ্ছ মনে হবে; কারণ সেই মহৎ আকাঙ্ক্ষা অন্যান্য ক্ষুদ্র ইচ্ছাগুলোর গুরুত্বকে ম্লান করে দেবে।


তুমি বলো তুমি কোনো কিছু খুবই চাও, এবং তার জন্য সবকিছু করছো? ধুর! তুমি শুধু ইচ্ছার নাটক করছো!

তুমি কি সত্যিই ওই জিনিসটা ততটা চাও, যতটা একজন বন্দি চায় মুক্তি? যতটা এক মরতে বসা মানুষ চায় জীবন? একবার দেখো, কীভাবে বন্দিরা প্রায় অলৌকিকভাবে মুক্তির আশায় ইস্পাতের পাত ও পাথরের দেওয়াল ভেদ করে ফেলে, হাতে একটুখানি পাথর থাকলেও!


তোমার আকাঙ্ক্ষা কি সত্যিই এতটাই তীব্র? তুমি কি তোমার কাম্য জিনিসটার জন্য এমনভাবে পরিশ্রম করো, যেন তোমার জীবন তার উপর নির্ভর করছে? না, মোটেই না! তুমি জানো না আসলে "আকাঙ্ক্ষা" কাকে বলে।


আমি বলছি, যদি একজন মানুষ কোনো কিছু চায় বন্দির মতো করে, বা প্রাণপণে বাঁচতে চাওয়া মানুষের মতো করে—তাহলে সেই মানুষ বাধা-অবধি সব ধুয়ে-মুছে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।


প্রাপ্তির চাবিকাঠি হলো:

আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাস, এবং ইচ্ছাশক্তি।

এই চাবি অনেক বন্ধ দরজাই খুলে দিতে পারে।


ভয় হলো এমন এক শক্তি, যা আকাঙ্ক্ষাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেয়—এটি তার প্রাণশক্তিকে চুষে নেয়। ভয়কে অবশ্যই বিদায় জানাতে হবে।


আমার নিজের জীবনেও এমন সময় এসেছে, যখন ভয় আমাকে চেপে ধরেছে, বুক চেপে ধরেছে এমনভাবে যে সমস্ত আশা, আগ্রহ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা—সব কিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে।


কিন্তু, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি সেই দানবের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি; আর দেখেছি, পরিস্থিতি যেন কোনো এক আশ্চর্য উপায়ে সহজ হয়ে গেছে।


অথবা, সেই বাধা নিজেই মিলিয়ে গেছে, অথবা আমি এমন কোনো পথ পেয়েছি যা দিয়ে তাকে পার করা গেছে—কখনো নিচ দিয়ে, কখনো উপর দিয়ে, কখনো পাশ দিয়ে।


এ এক আশ্চর্য জিনিস—আমরা যখন সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কোনো সমস্যার সামনে দাঁড়াই, তখন একরকমভাবে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়, আর আমরা ভাবি—আরে, এত ভয় কীসের ছিল?


এটা কোনো কল্পনা নয়—এটা প্রকৃতির এক মহাশক্তিশালী বিধানের কাজ, যেটার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয়তো আমরা এখনও দিতে পারি না, কিন্তু চাইলেই পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারি।


মানুষ প্রায়ই বলে: “এই যে তোমরা নিউ থটের লোকেরা বলো ‘চিন্তা কোরো না’, এটা তো খুব সহজ কথা—কিন্তু একজন মানুষ কী করবে যখন ভবিষ্যতের সব সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে তার মন অশান্ত হয়ে ওঠে?”


তাহলে আমি শুধু এটুকুই বলবো—এই ধরনের ভাবনা-চিন্তায় সময় নষ্ট করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু না। ভবিষ্যতের যত কষ্ট, দুঃখ বা বিপদের কথা আমরা ভাবি, তার বেশির ভাগই কোনোদিনই বাস্তবে ঘটে না। আর যে অল্প ক’টা ঘটে, সেগুলোর প্রভাব অনেকটাই মৃদু হয়, যেমনটা আমরা ভয় পেতাম তার চেয়ে অনেক কম।


আর আশ্চর্যের কথা হলো, সেই সব বিপদের সময়, প্রায়শই এমন কিছু সহায়ক জিনিসও আসে যেগুলোর মাধ্যমে আমরা সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারি।


ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য শুধু বিপদই নয়, বরং সেই বিপদ কাটানোর উপায়ও বয়ে আনে। ঘটনা নিজের মতো করে ঠিকঠাক হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে এমন এক শক্তি আছে, যা যেকোনো সমস্যার মোকাবিলার জন্য সময়মতো প্রস্তুত হয়ে ওঠে।


ঈশ্বর কেবল বাতাসকে ছাঁটা মেষশাবকের উপযোগী করেন না, তিনিও মেষশাবককে উপযোগী করে তোলেন সেই বাতাসের জন্য। বাতাস আর কাঁচি একসাথে নামে না—মেষশাবককে প্রস্তুত হবার মতো সময় দেওয়া হয়, এমনকি অনেক সময় তার নতুন পশমও গজিয়ে ওঠে ঠান্ডা হাওয়ার আগে।


কারও সুন্দরভাবে বলা উচিৎ ছিল: দশ ভাগের নয় ভাগ চিন্তাই হয় এমন কিছু নিয়ে, যা কোনোদিন ঘটে না; আর বাকি এক ভাগ হয় এমন কিছু নিয়ে, যেগুলোর কোনো আসল গুরুত্বই নেই। তাহলে বলো, যদি এই কথাই সত্যি হয়, তাহলে কেন অযথা নিজেদের সঞ্চিত শক্তি এমন দুশ্চিন্তায় নষ্ট করব?


বরং বাস্তব সমস্যা এসে পড়লে তখন ভাবা যাক—ততদিন পর্যন্ত আমাদের শক্তি সঞ্চয় করে রাখা ভালো। তাতে দেখা যাবে, যখনই কোনো বিপদ আসবে, আমরা অনেক বেশি প্রস্তুত ও সক্ষম হয়ে উঠব সেই মুহূর্তে।


আসলে, একজন সাধারণ মানুষ বা নারীর সব শক্তি কোন কাজে শেষ হয়ে যায় বলো তো? সত্যিকারের সমস্যা সমাধানে? না, বরং আসন্ন সমস্যা নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তায়।


সব সময় "আগামীকাল, আগামীকাল"—কিন্তু সেই আগামীকাল তো কখনো আসে না, যেভাবে আমরা তাকে ভয় করতাম। আগামীকাল তো খারাপ জিনিসের সঙ্গেই ভালো কিছু নিয়েও আসে।


আমার তো হাসি পায়, যখন আমি বসে ভাবি—আগে যেসব জিনিস নিয়ে আমি ভয় পেতাম, সেগুলো কই? কোথায় গেলো সেগুলো? অনেকগুলোর কথা তো মনেই পড়ে না এখন।

তোমার দুশ্চিন্তার সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই—এই অভ্যাস কাটানোর উপায় এটাই নয়। তার চেয়ে বরং মনোসংযোগের চর্চা করো, এবং তারপর শেখো কীভাবে কোনো ইতিবাচক বিষয়ে একাগ্র হওয়া যায়। তখন দেখবে, দুশ্চিন্তার চিন্তাগুলো আপনাতেই মিলিয়ে গেছে।


মনের এক সময়ে কেবল একটি বিষয়ে মনোযোগ থাকে, সুতরাং তুমি যদি কোনো উজ্জ্বল বা আশাজনক বিষয়ে মনোযোগ দাও, তবে সেই অন্য নেতিবাচক ভাবনাগুলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাবে। বিরক্তিকর বা অযাচিত চিন্তাকে জয় করার এরচেয়ে ভালো উপায় আর নেই—এদের সঙ্গে যুদ্ধ করো না, বরং বিপরীত প্রকৃতির চিন্তার প্রতি মনোযোগ দাও। তাহলেই সমস্যার সমাধান ঘটবে।


যখন মনের ভেতর দুশ্চিন্তা ভরে থাকে, তখন সে কোনো উপকারি পরিকল্পনা করতে পারে না। কিন্তু যখন তুমি মনের মধ্যে উজ্জ্বল, সহায়ক ভাবনা রাখো, তখন মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে শুরু করে। এবং যখন সময় আসে, তখন তুমি নিজের ভেতর থেকেই নানারকম পরিকল্পনা ও কৌশল পেয়ে যাবে, যার সাহায্যে তুমি পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবে।


তোমার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক রাখো, তাহলেই সবকিছু আপনাআপনি ঠিকঠাক হয়ে যাবে।


দুশ্চিন্তা করে কোনো লাভ হয়নি, আর কোনোদিন হবেও না।


আনন্দময়, আশাবাদী এবং সুখকর চিন্তাগুলোই আমাদের জীবনে আনন্দময়, আশাবাদী ও শুভ ফল এনে দেয়—আর দুশ্চিন্তা সেগুলোকেই তাড়িয়ে দেয়।


তাই সঠিক মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলো।



অধ্যায় ৮: মানসিক নিয়ন্ত্রণের সূত্র

ভাবনা: বিশ্বস্ত সেবক না কি অত্যাচারী প্রভু—কীভাবে তুমি তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে—জেগে থাকাকালীনই নয়, নিদ্রাবস্থাতেও মস্তিষ্কের সৃজনশীল কাজ—সমস্যার সমাধান হয় নিজের অজান্তেই—“মানসিক ইঞ্জিন” চালানোর কৌশল—মনের গতি কমিয়ে দেওয়া শিখতে হবে।


তোমার চিন্তাগুলো হয় বিশ্বস্ত সেবকের মতো কাজ করবে, নয়তো অত্যাচারী প্রভুর মতো তোমার উপর শাসন চালাবে—সবই নির্ভর করছে তুমি তাদের কেমন আচরণ করতে দাও তার উপর। সিদ্ধান্তটা তোমার—তুমি বেছে নাও।

তোমার ইচ্ছাশক্তির নেতৃত্বে তারা যদি কাজ করে, তবে তারা তোমার কাজই করবে, জাগ্রত অবস্থায় তো বটেই, এমনকি ঘুমের মধ্যেও—এমন অনেক মানসিক কাজ ঘুমের সময়ই সম্পন্ন হয়, যখন আমাদের সচেতন মন বিশ্রামে থাকে। এ বিষয়ে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সকালে উঠে দেখা যায় কোনো জটিল সমস্যার সমাধান যেন হঠাৎই পাওয়া গেছে, যদিও তুমি নিজে তাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে—অন্তত তাই মনে হয়েছিল।


অথচ, যদি তুমি অসতর্ক হও, তবে এই চিন্তাগুলো তোমার উপর চেপে বসবে, তোমাকে ক্রীতদাস বানিয়ে ফেলবে। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই তাদের মস্তিষ্কে এলোমেলো ঘোরাফেরা করা উদ্ভট চিন্তাগুলোর দাস।


তোমার মন তোমার উপকারের জন্য দেওয়া হয়েছে—তোমাকে ব্যবহার করার জন্য নয়। কিন্তু খুব কম লোকই এটা বোঝে, এবং সত্যিকারের মানসিক ব্যবস্থাপনার কলা রপ্ত করেছে। এই রহস্যের চাবিকাঠি হচ্ছে মনোযোগ বা একাগ্রতা (Concentration)।


একটু চর্চা করলেই যে কেউ তার “মানসিক যন্ত্র” সঠিকভাবে চালাতে পারবে। যখন তোমার মানসিকভাবে কোনো কাজ করার থাকে, তখন অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে কেবল সেটার দিকেই মনোযোগ দাও—তখন দেখবে, মন পুরোপুরি কাজে লেগে গেছে এবং কাজটা দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে। কোনো ঘর্ষণ নেই, অপচয় নেই—শক্তির প্রতিটি কণাই কাজে লাগছে।


একজন দক্ষ “মানসিক ইঞ্জিনিয়ার” জানে কখন ইঞ্জিন চালাতে হয়, আর কখন তাকে বিশ্রাম দিতে হয়। কাজ শেষ হওয়ার পর কেউ যদি ইঞ্জিনে কয়লা ঠেলে যায়, তাহলে সেটা তো অতিরিক্ত গতি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। কিছু লোকের আচরণ যেন এমন যে, ইঞ্জিন চলবে কি চলবে, কাজ থাক বা না থাক। তারপর আবার অভিযোগ করে, “ইঞ্জিনটা তো বেশ কষ্টে আছে!”


আমাদের মনও একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রের মতো। তাকে যত্নে রাখতে হবে।


যারা মানসিক নিয়ন্ত্রণের নিয়ম জানে, তাদের কাছে একথা হাস্যকর লাগে—লোকজন বিছানায় শুয়ে রাতভর ভাবছে দিনের চিন্তা বা আগামী দিনের ভয় নিয়ে!


আসলে, মনের গতি কমিয়ে দেওয়াটা একদম সম্ভব, যেমন যান্ত্রিক ইঞ্জিনের গতি কমানো যায়। আজকের এই “নতুন ভাবনার যুগে” হাজার হাজার মানুষ এটা শিখছে। সবচেয়ে ভালো উপায় কী? এমন কিছু ভাবো যা বিরক্তিকর চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।


বিরূপ চিন্তার সঙ্গে যুদ্ধ করো না—তাতে শক্তির অপচয় হয়। বরং মন থেকে একে ছেড়ে দাও। "আমি এটা ভাববো না! ভাববো না!"—এইরকম করে ভাবলে বরং সেটা আরও বেশি মাথায় ঢুকে পড়ে, কারণ তখনও তুমি সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছো।


তাই একে ছেড়ে দাও। পুরো মনোযোগ দাও অন্য কোনো বিষয়ে—এবং ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সেখানেই মন আটকিয়ে রাখো। একটু চর্চা করলে তুমি অনেকটা এগিয়ে যাবে।


মনে রেখো—এক সময়ে একটাই চিন্তা মনকে দখল করে রাখতে পারে। তাই ভালো একটা চিন্তার উপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দাও, দেখবে, অন্যগুলো চুপচাপ সরে পড়বে। নিজের উপর পরীক্ষা করে দেখো!


অধ্যায় ৯: জীবনশক্তির জাগরণ

একটি সার্বিক জাগরণ জরুরি—জীবনকে প্রবাহিত হতে দাও—ভাবনা, কথা ও কর্মে তার প্রকাশ—সচেতন জীবনের অভিব্যক্তি—দাবি ও অনুশীলনের প্রয়োজন।


আমি তোমাকে আগেই বলেছি—ভয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া কতটা প্রয়োজনীয়। এখন আমি তোমার মধ্যে জীবনপ্রবাহ সঞ্চার করতে চাই।

তোমাদের অনেকেই এমনভাবে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছো, যেন তোমরা মৃত—

কোনো উদ্দীপনা নেই,

কোনো কর্মস্পৃহা নেই,

কোনো প্রাণশক্তি নেই,

কোনো আগ্রহ নেই—

জীবনের কোনও চিহ্নই নেই!


এভাবে চলা চলবে না। তুমি স্থবির হয়ে পড়ছো।

জেগে ওঠো! একটু প্রাণের চিহ্ন দেখাও!

এই পৃথিবী মৃতদের বিশ্রামের স্থান নয়—এটা জীবন্ত, সজীব, সচেতন মানুষের স্থান।

তোমার মধ্যে একটা সাধারণ জাগরণ ঘটতে হবে, যদিও অনেকে এতটাই অচেতন হয়ে পড়েছে যে, তাদের জাগাতে গেলে গ্যাব্রিয়েলের শিঙার আওয়াজও যথেষ্ট হবে না। তারা ভাবে তারা জীবিত, অথচ তারা মৃত—সেই জীবন-মূল্যহীন এক ঘোরলাগা অস্তিত্বে।


আমাদের উচিত, জীবনকে নিজের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে দেওয়া—এবং তাকে প্রাকৃতিকভাবে প্রকাশ করতে দেওয়া।

জীবনের ছোট ছোট দুশ্চিন্তা কিংবা বড় দুঃখগুলোকে এমন প্রভাব বিস্তার করতে দিও না যেন তারা তোমার প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়।

তোমার ভিতরে যে জীবনশক্তি রয়েছে, তাকে জোরালোভাবে দাবি করো—তাকে চিন্তায়, কাজে, আচরণে প্রকাশ করো।

তখন দেখবে, তুমি নতুন করে উদ্দীপ্ত হচ্ছো—তোমার প্রাণশক্তি ও কর্মশক্তি যেন ফেঁপে উঠছে আনন্দে!


তোমার কাজে প্রাণ দাও—তোমার আনন্দে প্রাণ দাও—নিজেকেও প্রাণবন্ত করো।

এই আধা-মনোভাব নিয়ে কাজকর্ম কোরো না। তুমি যা করছো, ভাবছো, বলছো—তাতে আগ্রহ নাও, মন দাও।

আমরা যদি একটু জেগে উঠি, তাহলে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বিষয়গুলোতেও কত রকমের আগ্রহ ও আনন্দ লুকিয়ে আছে, সেটা বোঝা যায়!


আমাদের চারপাশে কত রকমের ঘটনা ঘটে চলেছে—আকর্ষণীয়, বিস্ময়কর। কিন্তু আমরা সেগুলো দেখতে পারি না, কারণ আমরা নিজেদের মধ্যে জীবনশক্তিকে জাগ্রত করি না, কেবল বেঁচে থাকি—জীবনকে যাপন করি না।


জীবনের প্রতিদিনের কাজ—চিন্তা ও আচরণ—যদি কেউ প্রাণ দিয়ে না করে, তাহলে সে কখনোই সত্যিকারের কিছু করে উঠতে পারে না।

বিশ্বের দরকার প্রাণবন্ত, জীবিত মানুষ।


তুমি একটু চোখ তুলে চারপাশের মানুষের চোখের দিকে তাকাও—তুমি দেখতে পাবে, খুব কম মানুষের চোখে সেই সচেতন জীবনের দীপ্তি আছে।

বেশিরভাগ চোখই ফাঁকা, নিষ্প্রাণ।

জীবিত মানুষ সেই, যার দৃষ্টিতে থাকে বেঁচে থাকার স্পষ্ট চিহ্ন—যে কেবল টিকে থাকে, সে জীবিত নয়।


আমি চাই, তুমি এই সচেতন জীবনের অনুভব অর্জন করো।

একে তোমার জীবনে প্রকাশ করো, যাতে তুমি নিজেই দেখতে পাও মানসিক বিজ্ঞান (Mental Science) তোমার জন্য কী করতে পেরেছে।


আজ থেকেই কাজ শুরু করো—নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজ।

এটা তুমি পারবে, যদি তুমি সত্যি এই কাজে আগ্রহ রাখো।

বেঁচে থাকো, কেবল টিকে থেকো না!

দাবি ও অনুশীলন

"আমি জীবিত।"


তোমার মনে এই ভাবনা গভীরভাবে গেঁথে নাও যে, তোমার ভিতরে যে ‘আমি’ আছে, সে সম্পূর্ণভাবে জীবিত—তুমি মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণভাবে জীবনকে প্রকাশ করছো।

এই চিন্তাকে মন থেকে কখনোই হারিয়ে যেতে দিও না।

বারবার নিজেকে স্মরণ করাও এই দাবিকৃত বাক্যটি—"আমি জীবিত"।

এই ভাবনাকে বারবার মনে ফিরিয়ে আনো, যতবার মনে পড়ে।

তোমার মানসিক দৃষ্টিতে এই চিত্রটিকে ধরে রাখো—

তুমি প্রাণশক্তিতে ভরপুর, তুমি জীবনের স্পন্দনে সজীব।


এই বাক্যটি জপ করো,

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বলো—

রাতের ঘুমে যাওয়ার আগে বলো—

খাওয়ার সময় বলো—

প্রতিদিন যতবার পারো, অন্তত ঘণ্টায় একবার বলো।


তোমার মনে একটি দৃঢ় চিত্র তৈরি করো—

তুমি একজন প্রাণবন্ত, সজীব মানুষ।

এই চেতনার সঙ্গে বাঁচো, এই অনুভূতির সঙ্গে প্রতিটি কাজ করো।


কোনো কাজ শুরু করার আগে বলো: "আমি জীবিত!"

আর সেই কাজে যতটা সম্ভব প্রাণ ঢেলে দাও।


যদি মন খারাপ হয়, যদি তুমি বিষণ্ণতা অনুভব করো,

তখন জোর দিয়ে বলো: "আমি জীবিত!"

তারপর কয়েকটা গভীর শ্বাস নাও,

প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে মনে রাখো—তুমি শক্তি আর জীবন গ্রহণ করছো।

প্রতিটি নিঃশ্বাসে মনে করো—তুমি পুরোনো, মৃত, নেতিবাচক সব কিছু ত্যাগ করছো।

তুমি সেগুলো থেকে মুক্ত হচ্ছো—খুশিতে।

সবশেষে জোরে, আন্তরিকভাবে বলো: "আমি জীবিত!"

আর যখন বলো, মনে-প্রাণে বিশ্বাস করো।


তবে শুধু মুখে বললেই হবে না—

তোমার ভাবনা যেন রূপ নেয় কাজে।

শুধু বলেই সন্তুষ্ট থেকো না যে তুমি জীবিত—

তোমার কর্মে তা প্রমাণ করো।


কাজে আগ্রহ দেখাও।

মন খারাপ করে, ফাঁকা দৃষ্টিতে ঘোরাফেরা কোরো না।

অলস কল্পনায় ডুবে থেকো না।

নেমে পড়ো জীবনের কাজে।

বাঁচো, সত্যিকারভাবে বাঁচো।


অধ্যায় ১০: অভ্যাস-মনের প্রশিক্ষণ

অবচেতন মন—সঠিক প্রেরণা প্রেরণের গুরুত্ব—স্বয়ংক্রিয় অভ্যাস—“এই দুটি কাজের মধ্যে কোনটি করব?”—নতুন অভ্যাস গঠন—পুরোনো অভ্যাস ভাঙা—“শুধু একবারই” ধারণা—মন একটি কাগজের টুকরো—মানসিক ভাঁজ।


প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক উইলিয়াম জেমস একদম সঠিকভাবে বলেছেন—

"সব শিক্ষার মূল কথা হচ্ছে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে শত্রু না করে মিত্র করে তোলা। এজন্য আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যত বেশি উপকারী কাজকে স্বয়ংক্রিয় ও অভ্যাসে পরিণত করা যায়, ততই মঙ্গল। একইভাবে, যেসব অভ্যাস আমাদের ক্ষতিতে আসতে পারে, সেগুলো থেকে নিজেকে সাবধান রাখতে হবে। নতুন কোনো অভ্যাস গড়ে তোলার সময় বা পুরোনো কোনো অভ্যাস ছাড়ার ক্ষেত্রে, যতটা সম্ভব শক্তিশালী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ উদ্যোগ নিতে হবে। যতক্ষণ না নতুন অভ্যাসটি জীবনে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যতিক্রম হতে দেওয়া চলবে না। যে কোনো সংকল্প অথবা আবেগ-অনুপ্রেরণাকে প্রথম সুযোগেই কাজে লাগাও, যা তোমাকে কাঙ্ক্ষিত অভ্যাসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।"


এই উপদেশ Mental Science-এর শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত হলেও, এটা এত সরল ও কার্যকরভাবে বলা হয়েছে যে তা বিশেষ গুরুত্ব পায়।

এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—

আমাদের উচিত অবচেতন মনের মধ্যে সঠিক প্রেরণা ও অভ্যাস পাঠানো, যাতে সেগুলো স্বয়ংক্রিয় হয়ে যায়, আমাদের দ্বিতীয় স্বভাব হয়ে ওঠে।


অবচেতন মন হলো একটি বিরাট গুদামঘর, যেখানে আমরা নিজেরা এবং অন্যরা নানা রকম পরামর্শ, ভাবনা, অভ্যাস পাঠিয়ে দিই।

এটি একটি অভ্যাস-মন—এবং আমরা যদি খেয়াল না রাখি, তবে খারাপ অভ্যাসগুলোও এখানে স্থান পায় এবং আমাদের বারবার সেই কাজগুলো করতে উৎসাহিত করে।


একবার কোনো কাজ অভ্যাসে পরিণত হলে, প্রতিবার সেটি করতে সহজ লাগে।

এবং সেই সহজতার মধ্য দিয়ে একসময় আমরা ঐ অভ্যাসের দাস হয়ে পড়ি—

ঐ অভ্যাস তখন আমাদের শেকলে বাঁধে, কখনো কখনো এমনকি আমাদের মুক্ত হওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে।


তাই আমাদের উচিত,

আজ থেকেই ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা—ভবিষ্যতের কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।


একদিন আসবে, যখন আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিতে হবে—

তখন আমরা হয় অভ্যাসবশত ঠিক কাজটি করে ফেলব অনায়াসে,

না হয় ভুল অভ্যাসের জালে পড়ে হোঁচট খেয়ে যাবো।


সে দিনটিতে আমরা কী করব—

আজকের প্রস্তুতি ও অভ্যাসের উপর তা নির্ভর করছে।

আমাদের সব সময় সচেতন থাকতে হবে, যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত অভ্যাস গড়ে না ওঠে।

আজ কোনো নির্দিষ্ট কাজ করলে হয়তো তেমন ক্ষতি হবে না, আগামীকালও নাও হতে পারে।

তবে সমস্যা তখনই শুরু হয়, যখন সেই কাজটি একটি অভ্যাসে পরিণত হয়।


যখন আপনি এমন দ্বিধার সামনে পড়েন:

“এই দুটি কাজের মধ্যে কোনটা করব?”

তখন সবচেয়ে ভালো উত্তর হলো:

“আমি সেটাই করব, যা আমার অভ্যাসে পরিণত হোক আমি চাই।”


নতুন কোনো অভ্যাস গড়ে তোলার সময় কিংবা পুরোনো কোনো অভ্যাস ভাঙার সময়,

আপনাকে পুরো উদ্যম দিয়ে কাজে নেমে পড়তে হবে—

যতটা সম্ভব উৎসাহ ও শক্তি দিয়ে শুরু করতে হবে,

কারণ শুরুতেই বেশি অগ্রগতি করতে পারলে,

আগে গড়ে ওঠা অভ্যাসের সঙ্গে যখন সংঘাত হবে, তখন সেই পূর্ব-সঞ্চিত শক্তি আপনাকে এগিয়ে রাখবে।


অবচেতন মনে যতটা সম্ভব গভীর ছাপ ফেলতে হবে শুরুতেই।

তারপর সাবধানে থাকতে হবে—

সবচেয়ে বড় বিপদ আসে যখন আপনি নিজেকে বলেন:

“এই একবারই তো করছি...”

এই “শুধু একবারই” ভাবনা যতগুলো ভালো অভ্যাসের জন্মকে হত্যা করেছে,

ততটা ক্ষতি আর কিছু করেনি।

আপনি যখন একবার হলেও এই ছাড় দিয়ে দেন,

সেই মুহূর্তেই আপনি সেই পালা-করা wedges বা কু-অভ্যাসের সরু প্রান্তটিকে সুযোগ করে দিলেন,

যা ধীরে ধীরে আপনার সব সংকল্পকে ভেঙে ফেলবে।


ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—

যখনই আপনি প্রলোভনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন,

আপনার সংকল্প ততটাই শক্তিশালী হবে।

প্রতিবার যখন আপনি সেই চিন্তাকে কার্যকর করেন, অর্থাৎ সেই অভ্যাসটি বাস্তব রূপ দেয়,

আপনার অভ্যাসিক শক্তি বাড়তে থাকে।

প্রতিটি ইতিবাচক কাজ আপনার মূল সংকল্পকে আরও মজবুত করে তোলে।


মানুষের মনকে এক টুকরো কাগজের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে,

যেটি একবার ভাঁজ করলে পরে সেই ভাঁজেই ফিরে যেতে চায়।

যদি আমরা নতুন ভাঁজ তৈরি করি,

তাহলে কাগজটি (অর্থাৎ মন) নতুন ভাঁজটিকে অনুসরণ করবে।


এই ভাঁজই আমাদের মানসিক অভ্যাস।

প্রতিবার একটি ভাঁজ তৈরি হলে,

পরবর্তীতে সেই দিকেই মন গিয়ে পড়ে—এটাই তার স্বাভাবিক প্রবণতা।


তাই আসুন আমরা সঠিক দিকে মনোভাবের ভাঁজ ফেলি,

যাতে আমাদের অভ্যাসগুলোও সঠিক পথে গড়ে ওঠে।


অধ্যায় ১১: আবেগের মনস্তত্ত্ব

(The Psychology of Emotion)


আবেগ মূলত অভ্যাসনির্ভর—এগুলোকে দমন, বৃদ্ধি, রূপান্তর, বা পরিবর্তন করা যায়।

অসঙ্গত আবেগকে দমন করার উপযুক্ত সময়—হিংসা, ক্রোধ, দোষারোপ, দুশ্চিন্তা—

এইসব আবেগের ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি এবং কীভাবে এই অভ্যাসগুলোকে নির্মূল করা যায়।


আমরা সাধারণত ভাবি, আবেগ যেন অভ্যাস থেকে আলাদা কিছু।

আমরা সহজেই মেনে নিই যে কার্যকলাপের অভ্যাস, এমনকি চিন্তার অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে—

কিন্তু আবেগকে অনেকেই শুধু “অনুভূতির” বিষয় বলে ধরে নেয়,

এবং ভাবেন, এর সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার কোনো সম্পর্ক নেই।


কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই পার্থক্য সত্ত্বেও,

আবেগও অনেকাংশে অভ্যাসনির্ভর।

একজন ব্যক্তি যেমন কোনো কাজ বা চিন্তার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন,

তেমনি তিনি তার আবেগকে দমন, বাড়ানো, রূপান্তর বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।


মনের বিজ্ঞানের একটি মূল সূত্র হলো:

“আবেগ পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে গভীর হয়।”

কোনো একটি অনুভূতি যদি কাউকে একবার ভালোভাবে গ্রাস করে ফেলে,

তাহলে দ্বিতীয়বার সেই একই আবেগে আত্মসমর্পণ করা আরও সহজ হয়ে যায়,

এবং তৃতীয়বার আরও সহজ—

এইভাবে ক্রমশ সেই নির্দিষ্ট আবেগটি তার “দ্বিতীয় স্বভাব” হয়ে দাঁড়ায়।


যদি কোনো অপছন্দনীয় আবেগ আপনার মধ্যে স্থায়ী হতে চায়,

তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেটিকে দমন বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

কারণ যতবার আপনি সেই অনুভূতিতে ডুবে যান,

ততবার তার শিকড় আরও গভীরে প্রবেশ করে,

এবং একসময় সেটিকে ছেঁটে ফেলা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ে।


আপনি কি কখনো হিংসুক হয়েছেন?

তাহলে নিশ্চয়ই মনে আছে, কিভাবে হিংসা প্রথমে খুব সূক্ষ্মভাবে আপনার মনে ঢুকেছিল,

কীভাবে কানে কানে বিষাক্ত সন্দেহের কথা বলেছিল—

আপনার মন সেই কু-পরামর্শগুলো শুনতে চাইছিলও।

তারপর আস্তে আস্তে সেই বিষবাষ্প আপনার চেতনা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সবকিছুই তখন হিংসার চশমায় সবুজ হয়ে উঠেছিল।


(এই “সবুজ” ধারণাটা শুধু রূপক নয়—

হিংসা লিভারকে প্রভাবিত করে এবং রক্তে বিষাক্ততা সৃষ্টি করে,

তাই হিংসার সঙ্গে “সবুজ” রঙের যোগসূত্র তৈরি হয়েছে।)


তারপর দেখবেন, সেই হিংসা কীভাবে ধীরে ধীরে দানবের মতো বড় হতে থাকে,

এমনকি আপনি চাইলেও সেটিকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না।

পরবর্তীবার হিংসুক হয়ে ওঠা যেন আরও সহজ মনে হলো।

এই আবেগ আপনার সামনে নানান “যুক্তিযুক্ত” উদাহরণ হাজির করল—

যাতে মনে হতে লাগল, আপনার হিংসা পুরোপুরি ন্যায়সঙ্গত!


এভাবেই গড়ে ওঠে আবেগের অভ্যাস।

এইসব নেতিবাচক আবেগ বারবার ফিরে আসে, যতক্ষণ না আপনি সচেতনভাবে সেগুলিকে দমন করেন।


এই অধ্যায়ে মূলত সেই কৌশলের কথাই বলা হবে—

কীভাবে এই আবেগগুলিকে রোধ করা যায়,

এবং কীভাবে আমরা নিজেদের আবেগের প্রকৃত মনস্তত্ত্ব বুঝে এগিয়ে যেতে পারি।


অধ্যায় ১১: আবেগের মনস্তত্ত্ব (পরবর্তী অংশ)

(The Psychology of Emotion – Continued)


এ কথা প্রতিটি আবেগ ও অনুভূতির ক্ষেত্রেই সত্য।

আপনি যদি রাগের বশে নিজেকে ছেড়ে দেন,

তবে পরবর্তীতে আরও সামান্য উসকানিতেই রেগে যাওয়া আরও সহজ হবে।


"অমানবিক" বা "নীচ" ব্যবহার ও অনুভবের অভ্যাস খুব দ্রুতই

নিজেকে সুসংগঠিত করে গৃহস্থালির মতো স্থান করে নিতে পারে—যদি আপনি তাকে প্রশ্রয় দেন।

দুশ্চিন্তা (worry) একটি বিশাল অভ্যাস-দানব,

যা খুব সহজেই বড় হয় এবং মোটা তাজা হয়ে উঠে।


মানুষ শুরুতে বড় কোনো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করে,

তারপর ছোট ছোট বিষয়েও উৎকণ্ঠিত হতে থাকে।

এক সময় সামান্য কিছু হলেই চিন্তা শুরু হয়—

তারা ভাবে, চারপাশে নানা অমঙ্গল অপেক্ষা করছে।


কেউ যাত্রা শুরু করলে নিশ্চিত হয়, দুর্ঘটনা ঘটবেই।

টেলিগ্রাম এলে মনে হয় নিশ্চয়ই ভয়ানক কিছু ঘটেছে।

শিশু একটু চুপচাপ থাকলে, চিন্তিত মা ভাবে, সে অসুস্থ হয়ে পড়বে,

এবং শেষ পর্যন্ত মরেই যাবে!

স্বামী যদি কিছুটা চিন্তিত দেখায়,

কারণ সে হয়তো কোনো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে ভাবছে,

তবুও স্ত্রী ভাবেন, স্বামী বুঝি আর তাকে ভালোবাসেন না—

আর সে কাঁদতে শুরু করে।


এইভাবে চলতে থাকে—চিন্তা, চিন্তা, চিন্তা—

প্রতিবারের অনুশীলনে এই চিন্তার অভ্যাস আরও জমাট বাঁধে।

অবশেষে এই ক্রমাগত চিন্তা কর্মেও রূপ নেয়।


মন শুধু বিষাক্ত হয় না—

ভ্রুর মাঝখানে গাঢ় দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে,

কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে কাঁপা, ক্ষিপ্র, ও বিরক্তিকর—

যেমনটা দেখা যায় সেইসব লোকদের মধ্যে যাদের জীবন জর্জরিত

চিন্তার বোঝায়।


“দোষ খোঁজা” (fault-finding) নামক মানসিক অবস্থাও

একটি আবেগ যা অনুশীলনের মাধ্যমে ভয়ংকর রূপ নেয়।


প্রথমে সে এইটাতে দোষ খোঁজে,

তারপর সেটাতে,

তারপর সবকিছুতেই।

এই ব্যক্তি একসময় হয়ে ওঠে “চিরকালের নিন্দুক”—

বন্ধু, আত্মীয়দের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়,

আর বাইরের মানুষ তাকে এড়িয়ে চলে।


মহিলারাই সবচেয়ে বেশি নালিশপ্রবণ (naggers)।

পুরুষেরা ভালো বলে নয়,

বরং কারণ হলো—

একজন পুরুষ যদি নালিশ করে বেড়ায়,

তাহলে অন্য পুরুষেরা তার সঙ্গে কড়া ব্যবহার করে

আর তাকে এই অভ্যাস ছাড়তে বাধ্য করে।

সে টের পায়—এই অভ্যাস তার নিজের জীবনকেই জ্বালাময় করে তুলছে।

ফলে সে পরিবর্তন আনে।


কিন্তু মহিলারা অনেক সময় এই অভ্যাস চর্চা করার বেশি সুযোগ পায়।

তবে, এই নালিশ করাও কেবল অভ্যাসমাত্র।

ছোট ছোট সূত্র থেকে গড়ে ওঠে এই দানব,

আর প্রতিবার যখন এটি প্রশ্রয় পায়,

সে তখন আরও একটুখানি শিকড় গেঁথে বসে—

আরও গভীরে, আরও মজবুতভাবে।


ঈর্ষা, অসৌজন্যতা, পরনিন্দা, গুজব ছড়ানো—

সবই এমন ধরণের মানসিক অভ্যাস।

এইসব বীজ প্রতিটি মানুষের মনে নিহিত,

শুধু দরকার উপযুক্ত জমি আর একটু সেচ,

তাতেই তারা বিকশিত হয়ে উঠে—

দৃঢ়, দানবীয়, শক্তিশালী রূপে । 


অধ্যায় ১১: আবেগের মনস্তত্ত্ব (শেষ অংশ)

(The Psychology of Emotion – Final Part)


আপনি যতবার এইসব নেতিবাচক আবেগকে প্রশ্রয় দেন,

প্রতিবারই এগুলোর পুনরাবৃত্তিকে আরও সহজ করে তুলেন।

কখনো কখনো একটি অযোগ্য আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে আপনি বুঝতেও পারেন না—

তার সঙ্গে এক গোটা মানসিক আগাছার পরিবার ঢুকে পড়েছে আপনার মধ্যে।


এটা কোনো পুরোনো রকম গির্জামুখী নীতিকথা নয়,

যা "খারাপ চিন্তা পাপ" বলে সাবধান করে।

এ কেবল আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাওয়া,

এই আবেগজনিত মনস্তত্ত্বের গভীর ও অটুট নিয়মের প্রতি।

এতে নতুন কিছু নেই—এটি পুরনো পাহাড়সমান সত্য,

এতটাই পুরোনো যে আমরা অনেকেই তা ভুলে গেছি।


আপনি যদি সত্যিই ইচ্ছা করেন

এইসব চির-অসন্তোষ ও অপ্রিয় স্বভাবগুলোর প্রকাশ ঘটাতে,

আর সেইসঙ্গে এই স্বভাবজাত দুঃখ-বেদনার মধ্যেই বাঁচতে চান—

তবে তা আপনার অধিকার—আপনার নিজের ব্যাপার।


আমার কিছু আসে যায় না। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি না,

কারণ আমাকে যথেষ্ট ব্যস্ত থাকতে হয়

নিজের অভ্যাস ও দুর্বলতাগুলোর দিকে নজর রেখে।

আমি শুধু এই বিষয়ে একটি প্রাকৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিয়ম জানাচ্ছি,

বাকি সিদ্ধান্ত আপনার ইচ্ছাধীন।


আপনি যদি চান এইসব অভ্যাসকে চেপে ফেলতে,

তবে দুইটি উপায় আপনার সামনে খোলা:


প্রথমত,

যখনই দেখবেন আপনি নেতিবাচক চিন্তা বা অনুভূতির দিকে ঝুঁকছেন,

সঙ্গে সঙ্গে তাকে জোরে ও দৃঢ়ভাবে বলুন:

"চলে যাও!"

প্রথমে এই আবেগ অসন্তুষ্ট বিড়ালের মতো পিঠ বাঁকাবে,

গর্জে উঠবে—

"তোমার সাহস কী আমাকে সরাতে চাও!"


তবে ভয় পাবেন না—

স্পষ্টভাবে বলুন: "ফু... চলে যাও!"

পরের বার সে আর এতটা সাহসী হবে না—

তাকে একটু হলেও ভয় লাগবে।


প্রতিবার আপনি যদি তাকে বাধা দেন, চেপে ধরেন,

তবে সেই প্রবণতাটি ক্রমশ দুর্বল হবে,

আর আপনার ইচ্ছাশক্তি আরও বলবান হয়ে উঠবে।


প্রফেসর উইলিয়াম জেমস বলেছেন:

"কোনো আবেগ প্রকাশ করতে অস্বীকার করুন, তাহলেই তা মরে যাবে।

রাগ প্রকাশের আগে দশ পর্যন্ত গুনুন, দেখবেন তা তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

'সাহস রাখতে বাঁশি বাজানো' কেবল উপমা নয়—

তা বাস্তব কৌশল।

অন্যদিকে, আপনি যদি সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকেন, হাঁফান, আর প্রতিটা কথার জবাবে নীরস সুরে বলেন—

তাহলে আপনার বিষণ্ণতা আরও গেঁথে বসবে।"

তিনি আরও বলেন:


"নৈতিক শিক্ষায় সবচেয়ে কার্যকরী উপদেশ হলো—

আপনি যদি নিজের আবেগীয় প্রবণতাকে জয় করতে চান,

তাহলে প্রথমেই ঠান্ডা মাথায়,

সেই বিপরীত আচরণগুলো সচেতনভাবে অনুশীলন করুন,

যেগুলো আপনি নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে চান।


ভ্রু মসৃণ করুন, চোখ উজ্জ্বল রাখুন,

পিঠ সোজা করে কথা বলুন,

উজ্জ্বল কণ্ঠে কথা বলুন,

সৌজন্যসূচক প্রশংসা করুন—

তাহলে আপনার হৃদয় যদি না-ও গলে,

তবু তার বরফ একদিন নিশ্চয়ই গলবেই।"


অধ্যায় ১২: নতুন মস্তিষ্ক-কোষের বিকাশ

অবাঞ্ছিত অনুভূতির অবস্থা — আমরা আমাদের আবেগের দাস নই — জাতির অধিকাংশই আবেগ দ্বারা অনেকাংশে চালিত — মানুষ তার আবেগের প্রকৃত নিয়ন্তা — নতুন মস্তিষ্ক-কোষের বিকাশ — অবাঞ্ছিত প্রকাশসমূহের সঙ্গে যুক্ত পুরাতন কোষের ব্যবহার বন্ধ — মস্তিষ্ক: মন-এর অঙ্গ ও উপকরণ — আমাদের প্রবণতা, স্বভাব ও পূর্বপ্রবৃত্তি — লক্ষ লক্ষ অপ্রযুক্ত মস্তিষ্ক-কোষ — মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ইচ্ছামতো গ্রহণ বা ত্যাগ করা যায় — মনের শক্তি শুভ চিন্তাকে উৎসাহিত করে, অশুভ চিন্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে — একটি সদর্থক চিন্তা বহু নেতিবাচক চিন্তাকে প্রতিহত করতে পারে — “চিন্তাকে ধারণ করা” — কোনও অভ্যাস গড়ে তোলার উপায় — এক মানসিক বৈশিষ্ট্য থেকে নিজেকে মুক্ত করা।


আমি ইতিপূর্বে বলেছি যে, অবাঞ্ছিত অনুভূতির অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি উপায় হলো সেগুলোকে মনের মধ্যে থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু এর চেয়েও উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো সেই অনুভূতি বা আবেগের ঠিক বিপরীতটি লালন করা, যা আপনি দূর করতে চান।


আমরা প্রায়শই নিজেকে ভাবি যেন আমাদের আবেগ ও অনুভূতির দাস—মনে করি এই অনুভূতিগুলোই আমাদের আসল সত্তা। কিন্তু এই ধারণা সত্য থেকে বহু দূরে। যদিও বাস্তবে দেখা যায়, মানুষের বিরাট একটি অংশ তাদের অনুভূতির গোলাম হয়ে গেছে এবং সেই অনুভব-প্রবাহের অনুগামী। তারা মনে করে এই আবেগ-অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই, তাই তারা আর প্রতিরোধ করে না।

তারা প্রশ্নহীনভাবে সেই অনুভূতির কাছে আত্মসমর্পণ করে, যদিও তারা জানে যে ঐ মানসিক প্রবণতা কিংবা আবেগ তাদের ক্ষতি ডেকে আনবে, সুখ নয় বরং দুঃখ ও ব্যর্থতা এনে দেবে। তারা বলে, “আমরা তো এমনই,” এবং সেখানেই তাদের কথা শেষ হয়।


কিন্তু নবীন মনোবিজ্ঞান মানুষকে আরও উন্নত কিছু শেখাচ্ছে। এটি বলছে, মানুষ তার আবেগ ও অনুভূতির প্রভু—দাস নয়। এটি শেখাচ্ছে যে, মস্তিষ্কে এমন কোষ গঠিত হতে পারে, যেগুলি কাঙ্ক্ষিত গুণাবলির প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম, এবং সেই পুরনো মস্তিষ্ক-কোষগুলি, যেগুলি দীর্ঘদিন ধরে অবাঞ্ছিত অনুভূতির বাহক ছিল, তারা বিশ্রামে যেতে পারে—অব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে।


মানুষ নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারে—নিজের প্রকৃতি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করতে পারে। এটি কোনও অলীক তত্ত্ব নয়—বরং একটি বাস্তব, প্রমাণিত সত্য। হাজার হাজার মানুষ এর কার্যকারিতা অনুভব করেছেন এবং ক্রমশই এই জ্ঞান মানবজাতির চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করছে।


এটি এমন এক সত্য যা বলে, যে মানুষ চাইলে নিজেকে ঢেলে সাজাতে পারে, এমনকি নিজের চরিত্রের গভীরতম বাঁকগুলোও পাল্টাতে পারে—শুধু চাই একটি সদিচ্ছা, একটি সদর্থক চিন্তা যা অন্ধকারকে প্রতিহত করে আলোর পথ করে দেয়।


যে-ই হোক মনের তত্ত্ব যাই বলুক না কেন, আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে মস্তিষ্কই হলো মনের অঙ্গ এবং যন্ত্র—অন্তত এই জীবনের প্রেক্ষিতে—and এই প্রসঙ্গে মস্তিষ্ককে গুরুত্ব দিতেই হবে।

মস্তিষ্ক একটি আশ্চর্য সুরযন্ত্রের মতো, যাতে লক্ষ লক্ষ কী-বোর্ড রয়েছে, এবং যার উপর আমরা অসংখ্য সুরের সম্মিলন বাজাতে পারি। আমরা যখন জন্মাই, তখন কিছু নির্দিষ্ট প্রবণতা, স্বভাব এবং পূর্বপ্রবৃত্তি নিয়ে আসি। আমরা চাইলে এই প্রবণতাগুলোর ব্যাখ্যা উত্তরাধিকারসূত্রে দিতে পারি, কিংবা পুনর্জন্মবাদ বা পূর্বজন্মের তত্ত্বেও বিশ্বাস করতে পারি—কিন্তু বাস্তবতাটা একই থেকে যায়।


দেখা যায়, কিছু নির্দিষ্ট ‘কী’ বা সুর সহজেই আমাদের স্পর্শে সাড়া দেয়। কিছু সুর এমনও থাকে, যা জীবনের ঘটনাপ্রবাহের হাওয়ায় আপনাতেই বেজে ওঠে। আবার কিছু সুর সহজে কম্পিত হয় না। কিন্তু আমরা যদি সদিচ্ছা ও সংকল্প দিয়ে সেই সহজে বাজা সুরগুলোকে দমন করতে চাই, তবে দেখা যায়, সেগুলি ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, আর হাওয়ার ঝাপটায় আর তেমন বাজে না।


আর যেসব সুর এতদিন স্পষ্টভাবে বাজত না—আমরা যদি সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিই, তাহলে অল্পদিনের মধ্যেই তারা সজীব হয়ে উঠতে পারে; তাদের স্বর ঝঙ্কার তুলে উঠবে, সুস্পষ্ট ও দীপ্তিময় হবে, এবং পূর্বের কর্কশ বা অপ্রিয় সুরগুলোকে ছাপিয়ে যাবে।


আমাদের মস্তিষ্কে লক্ষ লক্ষ অব্যবহৃত কোষ রয়েছে, যেগুলোর বিকাশ এখনও বাকি। আমরা তার এক ক্ষুদ্রাংশই ব্যবহার করছি—তার মধ্যে কিছু কোষ তো প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অতিরিক্ত ব্যবহারে। আমরা চাইলে এই ক্লান্ত কোষগুলোকে বিশ্রাম দিতে পারি, অন্য কোষগুলোকে কাজে লাগিয়ে।


মস্তিষ্ককে এমনভাবে অনুশীলন ও চর্চা করানো যায়, যা শুনতে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে সেইসব মানুষের কাছে, যারা এ বিষয়ে ভাবেননি কখনো। মানসিক অভিব্যক্তিগুলোকে আমরা ইচ্ছামাফিক গঠন করতে পারি, পরিণত করতে পারি, আবার পরিত্যাগও করতে পারি।

এখন আর কেউ বলতে পারে না, “আমার মনের এই খারাপ অবস্থা, আমি কিছু করতে পারি না।” কারণ, প্রতিকারের পথ আমাদের হাতেই।


আমরা যেভাবে চিন্তা করি, অনুভব করি বা কাজ করি—সেগুলো অভ্যাসের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। আমরা হয়তো একটি বিশেষ দিকের প্রতি প্রবণতা নিয়ে জন্মাই, কিংবা হয়তো এই প্রবণতাগুলো গড়ে ওঠে বাইরের প্রভাব, অনুকরণ, পাঠ্য ও শ্রব্য উপাদান, বা শিক্ষকের কথার মাধ্যমে। আমরা মানসিক অভ্যাসের এক সংকলন মাত্র।


প্রতিবার যখন আমরা কোনও অশুভ বা অনভিপ্রেত চিন্তা বা আচরণে লিপ্ত হই, তখন সেটিকে আবারো পুনরাবৃত্তি করা আরও সহজ হয়ে পড়ে। আর যতবার আমরা কোনও শুভ চিন্তা বা আচরণ করি, সেটিও আমাদের জন্য তত সহজতর ও স্বাভাবিক হয়ে যায়।


সুতরাং, আমাদের ভবিষ্যতের পথে কী সুর বাজবে—তা নির্ভর করছে আজকে আমরা কোন কী-গুলো ছুঁয়ে বাজাতে শিখছি তার উপর।


মানসিক বিজ্ঞানীরা সাধারণত ইতিবাচক চিন্তা ও মানসিক অভিব্যক্তিগুলিকে বলেন "পজিটিভ", আর নেতিবাচক ও অবাঞ্ছিত চিন্তাগুলিকে বলেন "নেগেটিভ"—এর পেছনে যথার্থ কারণ রয়েছে।

মানুষের মন স্বভাবতই এমন কিছু চিন্তা ও মানসিক অবস্থাকে চিনে নেয় যা তার নিজের মঙ্গলের পক্ষে সহায়ক, এবং সেসব চিন্তার জন্য সে পথ পরিস্কার করে দেয়—প্রতিরোধ করে না। এমন চিন্তাগুলো মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে সহজ হয়, আর এগুলোর প্রভাব নেতিবাচক চিন্তার তুলনায় অনেক বেশি গভীর। একটি সদর্থক চিন্তা একাধিক নেতিবাচক চিন্তার বিরুদ্ধেও কার্যকর হতে পারে।


অতএব, নেতিবাচক চিন্তা ও অনুভূতিকে প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো এর বিপরীতে পজিটিভ বা সদর্থক চিন্তাগুলিকে চর্চা ও বিকাশ ঘটানো।

ইতিবাচক চিন্তা হলো এক বলিষ্ঠ বৃক্ষের মতো, যা ধীরে ধীরে নেতিবাচক চিন্তার পুষ্টি কেড়ে নিয়ে সেটিকে নিঃশেষ করে দিতে পারে।


অবশ্য শুরুতে সেই নেতিবাচক চিন্তাগুলি তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, কারণ এটা তাদের কাছে এক জীবনের যুদ্ধের মতো। সহজভাবে বললে, নেতিবাচক চিন্তা তখন বুঝে ফেলে যে, যদি পজিটিভ চিন্তাটি বাড়ে—তবে তার শেষ সন্নিকটে। তাই সে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চারদিক উত্তাল করে তোলে, মানুষকে মানসিক অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।


মস্তিষ্কের কোষগুলোও বাকি সব জীবন্ত শক্তির মতোই—তারা অবসরপ্রাপ্ত হতে চায় না, কাজহীন হয়ে যেতে চায় না। তাই তারা প্রথমে বিদ্রোহ করে, প্রতিরোধ জানায়, ছটফট করে, যতক্ষণ না তারা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।


সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো, মনের এই আগাছাগুলোর দিকে যতটা সম্ভব কম মনোযোগ দেওয়া, এবং মনরূপী উদ্যানের নতুন ও সুন্দর উদ্ভিদগুলোর যত্ন ও পরিচর্যায় বেশি সময় ব্যয় করা।


উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার মধ্যে মানুষ-বিদ্বেষের প্রবণতা থাকে, তবে তা কাটানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো তার ঠিক বিপরীত গুণ—ভালোবাসা—কে চর্চা করা। ভাবুন ভালোবাসা, অনুভব করুন ভালোবাসা, এবং যতটা সম্ভব তা কাজে রূপ দিন।

স্নেহ ও মমতাপূর্ণ চিন্তা লালন করুন, এবং প্রতিটি মানুষের প্রতি যতটা সম্ভব সদাচরণ করুন।


শুরুর দিকে আপনি বাধার সম্মুখীন হবেন, কিন্তু ধীরে ধীরে ভালোবাসা ঘৃণাকে পরাস্ত করবে—আর সেই ঘৃণা নিস্তেজ হয়ে মরে যাবে।


আবার, যদি আপনি সহজেই হতাশ বা বিষণ্ণ হয়ে পড়েন—তাহলে হাসির চর্চা করুন, আনন্দময় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলুন। মুখের কোণে জোর করে হলেও হাসি ধরে রাখুন, এবং দৃঢ় মনোবলে চেষ্টা করুন, প্রতিটি বিষয়ে আলোর দিকটি দেখতে।


অবশ্যই সেই বিষণ্ণতার "নীল দানব" (blue-devils) রুখে দাঁড়াবে—আপনাকে দমিয়ে রাখতে চাইবে। কিন্তু আপনি তার কোনো তোয়াক্কা না করে শুধু আগ বাড়িয়ে যান—আনন্দ ও আশাবাদ চর্চা করে যান।

"উজ্জ্বল, হাসিখুশি ও সুখী"—এই হোক আপনার জীবনের মূলমন্ত্র, আর চেষ্টা করুন এই তিনটি শব্দকে বাস্তব করে তুলতে।


এমনটি করতে পারলেই আপনি নিজের মনের বাগানে শুভ্র ও সুন্দর ফুলের চারা রোপণ করছেন—যেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষাক্ত আগাছাগুলিকে একে একে গ্রাস করে ফেলবে।


এই পদ্ধতিগুলো প্রাচীন ও পুরাতন ধাঁচের মনে হতে পারে, কিন্তু এরা নিছক প্রাচীন নয়—এগুলো মনোবিজ্ঞানের চিরন্তন সত্য, এবং আপনি চাইলে এগুলোর সুফল নিজের জীবনে আনতে পারেন।

আপনি যদি একবার এর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন, তাহলে বিভিন্ন মানসিক বিদ্যালয়ের “দৃঢ় সংকল্প” বা “স্বয়ং-পরামর্শ” (auto-suggestion)-এর মত বিষয়গুলোকেও সহজে বুঝে কাজে লাগাতে পারবেন।


এই পদ্ধতির মাধ্যমে আপনি নিজেকে অলসতা থেকে উদ্যমী করে তুলতে পারেন, নিষ্ক্রিয়তা থেকে কর্মচঞ্চলতায় রূপান্তর ঘটাতে পারেন। সবটাই চর্চা আর ধৈর্যের বিষয়।


নিউ থট (New Thought) মতবাদীরা প্রায়ই বলেন “চিন্তাকে ধরে রাখো” (holding the thought)। এবং সত্যিই—ফল পেতে চাইলে চিন্তাকে অন্তরে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র ভাবনায় আটকে থাকলে চলবে না। আপনাকে সেই চিন্তাকে কার্যরূপে প্রকাশ করতেও হবে—অর্থাৎ তা এমনভাবে কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে, যেন তা আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়।


চিন্তা কর্মে রূপ নেয়, এবং সেই কর্ম আবার চিন্তাকে প্রভাবিত করে।

তাই আপনি যখন কোনও নির্দিষ্ট চিন্তাধারাকে “অভিনয়” বা “কার্যরূপে” প্রকাশ করেন, তখন সেই কাজটি আবার আপনার মনকে প্রতিফলিত করে, এবং মস্তিষ্কের সেই অংশের বিকাশ ঘটায়, যা ওই কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।


প্রতিবার আপনি একটি চিন্তাকে মনের মধ্যে স্থান দিলে, পরবর্তীবার সেই চিন্তার অনুসরণে কাজ করা আরও সহজ হয়ে পড়ে। আবার, প্রতিবার আপনি কোনো কাজ করলে, সেই কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত চিন্তাও আরও সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।


এইভাবে, চিন্তা এবং কাজ—উভয়ের মধ্যেই চলে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ধারা।


যখন আপনি আনন্দিত ও প্রফুল্ল অনুভব করেন, তখন আপনি স্বাভাবিকভাবেই হাসেন। আবার আপনি যদি ইচ্ছা করে একটু হাসেন, তবে নিজেকে আস্তে আস্তে আরও আনন্দিত অনুভব করবেন।

আমি যা বোঝাতে চাইছি, তা এই—


আপনি যদি কোনো একটি অভ্যাস গড়ে তুলতে চান, তাহলে প্রথমে তার উপযুক্ত মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি চর্চা করুন। আর সেই মানসিক অবস্থাটিকে গড়ে তোলার জন্য, সেই অভ্যাসের কার্যরূপ অনুশীলন করতে শুরু করুন।


এখন এই নিয়মটিকে বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখুন।

একটি কাজ বেছে নিন, যেটি আপনার মনে হয় করা প্রয়োজন, কিন্তু আপনি তা করতে মন থেকে অনিচ্ছুক। তখন সেই কাজটির পূর্ব-অনুভবকে নিজের মধ্যে গড়ে তুলুন—নিজেকে বলুন:

"আমি এই কাজটা করতে ভালোবাসি।"

তারপর সেই কাজটি করুন—উৎসাহ ও আনন্দ সহকারে!


কাজটি করার মধ্যে আগ্রহ খুঁজে বার করুন—সবচেয়ে ভালোভাবে কীভাবে করা যায়, তা ভাবুন—মনোযোগ দিন—নিজেকে সেই কাজের ভেতরে দিন। এবং আপনি দেখবেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজটি আপনি আগ্রহ ও আনন্দ সহকারে করছেন। আপনি একটি নতুন অভ্যাস গড়ে তুলেছেন।


এটি আপনি মানসিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে পারেন, যেটি আপনি ত্যাগ করতে চান।

এর বিপরীত গুণটি চর্চা করুন—ভাবুন, অনুভব করুন, এবং তাকে নিজের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করুন।

তারপর নিজের মধ্যে যে পরিবর্তন আসছে, তা খেয়াল করুন।


শুরুর দিকে কিছুটা বাধা আসবে—কিন্তু তাতে ভয় পাবেন না। বরং গাইতে থাকুন মনে মনে:

"আমি পারব এবং আমি করব!"

তারপর কাজ শুরু করুন—সম্পূর্ণ আন্তরিকতা ও দৃঢ়তায়।


এই কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—চিরকাল প্রফুল্ল থাকা এবং আগ্রহ ধরে রাখা।

যদি আপনি এটা বজায় রাখতে পারেন, তাহলে বাকিটা আপনার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে।


এভাবেই—একটি নতুন মন, একটি নতুন অভ্যাস, এবং একটি নতুন জীবন শুরু হয়।


অধ্যায় ১৩: আকর্ষণের শক্তি — ইচ্ছাশক্তির প্রভাব

মানসিক শক্তির অপচয় — সাফল্যপ্রার্থী নারী বা পুরুষ — কখন মানসিক শক্তি সর্বোত্তমভাবে কাজ করে — মন অবচেতনে কাজ করে, সেই প্রবল ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার ধারায় — চিন্তাশক্তির ছড়িয়ে যাওয়া — আকর্ষণের প্রবাহ থেকে বিচ্যুতি — আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা — জীবনের মূলেই রয়েছে “ভালোবাসা” — তথাকথিত “রাসায়নিক আকর্ষণ” — ইচ্ছা হচ্ছে এই সর্বজনীন জীবন-ভালোবাসার এক প্রকাশ।


আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি, ভয়কে দূর করা কতটা জরুরি—কারণ ভয় থাকলে আপনার ইচ্ছাশক্তি পূর্ণতায় কাজ করতে পারে না।

ধরা যাক, আপনি এই অংশটা অনেকটাই আয়ত্তে এনেছেন, কিংবা অন্তত এই পথে এগোতে শুরু করেছেন—এবার আমি আপনাকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি দিতে চাই। আমি এখানে বলছি মানসিক শক্তির অপচয়ের কথা।


না, আমি এমন কোনও গোপন ফাঁসের কথা বলছি না, যেটা ঘটে যখন আপনি নিজের গোপন কথা অন্যদের বলে ফেলেন—তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

আমি বলছি সেই অদৃশ্য ফাঁসের কথা, যখন আমাদের মন বারবার একেকটি ক্ষণস্থায়ী আকর্ষণ বা কল্পনার দিকে ধাবিত হয় এবং সেখানেই শক্তি ক্ষয় হয়।


কোনো কিছু অর্জন করতে চাইলে, সেই জিনিসটির প্রতি মনের একপ্রকার ভালোবাসা জন্মাতে হবে—মনকে এমনভাবে আকৃষ্ট ও সজাগ রাখতে হবে, যেন তার অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই যেন গুরুত্বপূর্ণ না থাকে।

যা আপনি অর্জন করতে চান, তার প্রতি আপনাকে প্রেমে পড়তে হবে—ঠিক যেমন করে কেউ প্রেমে পড়ে কোনো নারী বা পুরুষের।


এতে আমি মোটেই বলতে চাইছি না যে আপনি সেই বিষয়ের প্রতি এমন একরোখা হয়ে উঠবেন যে পৃথিবীর আর কিছুতেই আগ্রহ থাকবে না। তা হবে না, কারণ মনকে বিশ্রাম ও বৈচিত্র্য দিতেই হয়।

কিন্তু আমি বলতে চাইছি, সেই আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি যেন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে বাকিসব তার তুলনায় গৌণ মনে হয়।


একজন প্রেমে পড়া মানুষ যেমন অন্যদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে, জীবনের নানা কর্তব্য ও আনন্দ উপভোগ করে—তবু ভিতরে ভিতরে তার মন শুধু একটা সুরই গুনগুন করে: “শুধু এক জন”।

তার প্রতিটি কাজেই লুকিয়ে থাকে একটিই লক্ষ্য—সেই মানুষটিকে পাওয়া এবং তার জন্য একটি সুন্দর আশ্রয় তৈরি করা।


এই কথাটিই বোঝাতে চাই আমি।

আপনাকে প্রেমে পড়তে হবে সেই লক্ষ্য বা আকাঙ্ক্ষার প্রতি।

আর সেই প্রেম যেন হয় একান্ত ও আন্তরিক—এই আধুনিক যুগের "আজ ভালোবাসি, কাল অবহেলা করি"-জাতীয় হাল্কা প্রেম নয়।


বরং সেই পুরনো দিনের গভীর প্রেম, যা এক তরুণকে রাতে ঘুমোতে না দিয়ে, তার প্রিয়ার বাড়ির চারপাশ দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করত—শুধু নিশ্চিত হতে, সে এখনো ঠিকঠাক আছে কিনা।


এই হোক আপনার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার প্রতি প্রেম—এটাই আসল প্রেম।

এই প্রেমই আপনার চিন্তাশক্তিকে একত্র করে, শক্তির অপচয় রোধ করে, এবং আকর্ষণের স্রোতে আপনাকে প্রবাহিত করে সেই লক্ষ্যের দিকে।


সাফল্যকে আকর্ষণ করতে চাইলে, একজন মানুষ বা নারীকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যটিকেই নিজের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা—নিজের “রুলিং প্যাশন” বানাতে হবে। তাকে সবসময় মনে রাখতে হবে, মূল লক্ষ্যটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।

সাফল্য ঈর্ষাকাতর—এই কারণেই তাকে অনেক সময় “নারীরূপে” কল্পনা করা হয়। সে চায় মানুষের পূর্ণ মনোযোগ ও ভালোবাসা। আপনি যদি সেই ভালোবাসা অন্য কিছুতে বিলিয়ে দিতে থাকেন—যেমন দৃষ্টিনন্দন কোন ‘অন্য আকর্ষণীয় চিন্তা’র দিকে মন দিতে থাকেন—তবে সাফল্য রুষ্ট হয়ে আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে।


যদি আপনি মূল লক্ষ্যে একাগ্র থাকার বদলে বিচ্ছিন্ন খুঁটিনাটি জিনিসে মনোযোগ দিতে থাকেন, তবে ক্ষতি আপনারই।

মানসিক শক্তি তখনই সবচেয়ে কার্যকর হয়, যখন তা কেন্দ্রীভূত থাকে।

আপনাকে সেই আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যকে দিতে হবে আপনার সর্বোত্তম ও গভীরতম চিন্তা।


ঠিক যেমন একজন প্রেমিক নিজের ভালোবাসার মানুষটির মন জয় করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কৌশল ভেবে চলে, তেমনি একজন ব্যক্তি যিনি নিজের কাজ বা ব্যবসার প্রতি ভালোবাসায় আত্মহারা, তিনি নিজের মননশীলতা দিয়ে নানা নতুন পরিকল্পনা সৃষ্টি করেন।

আর দেখা যায়, তার চেতনায় একের পর এক নতুন আইডিয়া উঠে আসতে থাকে—যার অনেকগুলোই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর।


মনে রাখবেন, মন আমাদের অবচেতন স্তরে কাজ করে, এবং প্রায়শই সেটি সেই প্রবল ইচ্ছা বা মূল আকাঙ্ক্ষার পথ ধরে এগোয়।

মন তখন নানা জিনিস একত্র করে, জোড়া লাগায়, গঠন করে পরিকল্পনা—আর আপনি যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বোধ করেন, ঠিক তখনই সেই চিন্তাগুলো চেতনায় উদিত হয়, যেন আপনি বাইরের কারো কাছ থেকে অমূল্য সাহায্য পেয়ে গেলেন।


কিন্তু যদি আপনি নিজের চিন্তাশক্তিকে ছড়িয়ে ফেলেন, তাহলে অবচেতন মন বুঝতে পারে না, আসলে আপনি কী চান। ফলে সেদিক থেকে আপনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ হারান।

তার পাশাপাশি, যখন আপনি সচেতনভাবে পরিকল্পনার খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করছেন, তখন কেন্দ্রীভূত চিন্তার যে দুর্দান্ত প্রভাব, সেটাও আপনি হারিয়ে ফেলেন।


আরও একটি বিষয় হলো—যে ব্যক্তি নানা বিষয়ে একসাথে আগ্রহ রাখে, তার মনে একধরনের বিভাজন ঘটে যায়—ফলে সে সেই শক্তিশালী আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে না, যা একজন একনিষ্ঠ লক্ষ্য-পূজারী সৃষ্টি করতে পারে।

এমন ব্যক্তি না পারবে নিজের লক্ষ্যের সহায়ক মানুষ, জিনিস ও ফলাফলকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে, না পারবে সেই আকর্ষণের স্রোতে প্রবেশ করতে, যেখানে সহানুভূতিশীল মানুষজন তার লক্ষ্যে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।


আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি দেখেছি—যখনই আমি নিজের নিয়মিত কাজ থেকে মন সরিয়ে অন্য কিছুতে মন দিয়েছি, তখনই স্বল্প সময়ের মধ্যে আমার আয় কমে গিয়েছে, কাজের প্রাণশক্তি হ্রাস পেতে শুরু করেছে।

অনেকে বলতেই পারেন, “এটা স্বাভাবিক, কারণ আপনি হয়তো সেই সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ না করেই ফেলে রেখেছিলেন।” ঠিক কথা।

তবে আমি এমন ক্ষেত্রেও একই ফল দেখেছি, যেখানে সবকিছু সম্পন্ন হয়েছিল—শুধু ফসল ওঠার জন্য অপেক্ষা চলছিল।


এই অবস্থায় আমি যখন আবার মনটাকে আমার প্রকৃত লক্ষ্যের দিকে ফিরিয়ে দিলাম, তখন সেই বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করল।

আমি এখানে বলতে চাই না যে আমি কোনো প্রবল “মানসিক তরঙ্গ” পাঠিয়েছি, যার দ্বারা অন্য মানুষকে প্রভাবিত করেছি।

না—আমি শুধু নিজের ভেতরে অনুভব করতে শুরু করলাম, আমার যা আছে সেটা কতটা মূল্যবান, মানুষ সেটা কতটা চায়, আর সেটা জানলে তারা কতটা খুশি হবে।


এই ভাবনাগুলো যেন আমার কাজে প্রাণসঞ্চার করল—বীজ গজিয়ে উঠল।

এটা কল্পনা নয়, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা—যা আমি বহুবার অনুভব করেছি।

আমি এই বিষয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, এবং দেখেছি—আমাদের অভিজ্ঞতা মিলে যায়।


তাই, মনের এই শক্তি-চোরাগুলো বন্ধ করতে শিখুন।

আপনার আকাঙ্ক্ষাকে সতেজ ও সক্রিয় রাখুন, এবং সেটিকে যেন বিপরীত ইচ্ছার দ্বারা বিভ্রান্ত করা না হয়, তা নিশ্চিত করুন।


যা আপনি পেতে চান, তার প্রেমে পড়ে যান—আপনার কল্পনা দিয়ে তাকে খাওয়ান, মনে মনে তাকে সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন দেখুন, কিন্তু আপনার আগ্রহ কখনো হারাবেন না।

সবসময় মূল লক্ষ্যের দিকে নজর রাখুন, এবং আপনার একটি মূল আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত, প্রজ্বলিত ও বলিষ্ঠ রাখুন।


একসাথে অনেক মানসিক প্রেম করবেন না—মনসচেতন “বহুবিবাহ” করবেন না।

একসাথে একটি প্রেমই যথেষ্ট—অন্তত এক সময় একটিই থাকুক।


কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, জীবনের গোড়ায় যে শক্তি তা হলো একরকম ভালোবাসা।

তাঁরা বলেন, গাছের জলপ্রেমই তাকে বাধ্য করে শিকড় বাড়িয়ে জল পর্যন্ত পৌঁছাতে।

ফুলের সূর্যপ্রেমই তাকে অন্ধকার ছেড়ে আলোর দিকে এগোতে বাধ্য করে।

রাসায়নিক বন্ধন বা "chemical affinities" আসলে ভালোবাসারই এক রূপ।

আর ইচ্ছা হলো এই সর্বজনীন জীবনভালোবাসারই এক উজ্জ্বল প্রকাশ।


তাই, যখন আমি বলি “যা পেতে চান, তাকে ভালোবাসুন”, তখন আমি কেবল রূপকথার ভাষায় বলি না।

এই একান্ত ভালোবাসা ছাড়া আপনি পথের অন্তরায় অতিক্রম করতে পারবেন না, এই ভালোবাসা ছাড়া আপনি সেই কঠিন কাজের বোঝা বইতে পারবেন না।


আপনার যেটা প্রতি যত বেশি ইচ্ছা, সেটার প্রতি তত বেশি ভালোবাসা গড়ে ওঠে। আর সেই ভালোবাসা যত গভীর হয়, সেই লক্ষ্য আপনাকে তত জোরে আকর্ষণ করে—অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই।


তাই, এক সময়ে একটি জিনিসকেই ভালোবাসুন—মনকে বহুবিবাহে উৎসাহী করবেন না।


অধ্যায় ১৪: মহান গতিশীল শক্তি

সফল ও বলিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে ব্যর্থ ও দুর্বল মানুষের পার্থক্য — উদ্যম ও অদম্য সংকল্প — উদ্যম অপ্রচলিত নয় — স্নায়ুশক্তির অপচয় — মানব ইচ্ছাশক্তি: এক মহা গতিশীল শক্তি — যারা সত্যিই সফল হয়েছে — তারা কি সত্যিই “সাধারণ”? — আমাদের মধ্যেই রয়েছে সেই উপাদান — তাদের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? — আত্মবিশ্বাস — উপাদানের সঠিক ব্যবহার — "মহানত্বের কৌশল" — আপনার মনে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনার ভাণ্ডার — এক অশেষ উৎস।


আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন—জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে, সফল ও বলিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে ব্যর্থ ও দুর্বল মানুষের মধ্যে এক বিস্ময়কর পার্থক্য রয়েছে।

এই দুই শ্রেণির মানুষের গুণাবলি এত ভিন্ন যে আমরা সহজেই তা অনুভব করতে পারি, কিন্তু প্রায়ই ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না—সেই পার্থক্যটি আদতে কোথায়?


আসুন, এবার বিষয়টিকে একটু গভীরভাবে দেখি।


বাক্সটন একবার বলেছিলেন—


> “জীবনের অভিজ্ঞতা যতই দীর্ঘ হয়, ততই আমি নিশ্চিত হই যে দুর্বল ও শক্তিমান, ক্ষুদ্র ও মহান পুরুষদের মাঝে প্রকৃত পার্থক্যটা হলো—উদ্যম ও অদম্য সংকল্প। একবার যেই লক্ষ্য স্থির করা যায়, তখন তার জন্য মৃত্যু বা বিজয়—এই দুইয়ের বাইরে কিছুই নয়। এই গুণ যেকোনো কিছু অর্জন করতে সক্ষম—এমনকি প্রতিভা, পরিস্থিতি, সুযোগ—এইসবই ব্যর্থ হয়, যদি কোনো মানুষে এই গুণ না থাকে।”




বাক্সটনের কথার চেয়ে স্পষ্টভাবে এই ভাবনা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

তিনি যেন একেবারে কেন্দ্রে গিয়ে আঙুল রেখেছেন—সরাসরি হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছেন এই সত্যটি।


উদ্যম ও অদম্য সংকল্প—এই দুটি শক্তি একত্রে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে ফেলতে পারে, সবচেয়ে কঠিন প্রতিবন্ধকতাও পেরিয়ে যেতে পারে।

তবে অবশ্যই এই দুইটি গুণকে একত্রে ব্যবহার করতে হয়।

উদ্যম যদি থাকে, কিন্তু সংকল্প না থাকে, তবে সেই শক্তি অপচয় হয়ে যায়।


অনেক মানুষের মধ্যেই অপার শক্তি থাকে—তারা প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

তবু, তারা লক্ষ্যচ্যুত, তারা গন্তব্যের প্রতি একাগ্র নয়।

তাদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত শক্তি নেই—যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর ওপর প্রয়োগ করে সাফল্য আনা সম্ভব।


আমরা অনেকেই মনে করি, উদ্যম এক দুর্লভ গুণ।

কিন্তু সত্যি কথা হলো, চারদিকে তাকালেই এমন বহু মানুষকে দেখা যায়—যারা প্রাণশক্তিতে উথলে পড়ে।

তাদের মধ্যে অনেকে তো যেন ‘উদ্যমের অতিরিক্ত ভার’ নিয়েই চলছে।


তবু, আশ্চর্যের বিষয়, তারা কোনো অগ্রগতি করতে পারে না।

তারা সারাক্ষণই সেই উদ্যম অপচয় করে যাচ্ছে—

একবার এই বিষয়ে মাথা গলায়, পরক্ষণেই আরেকটি তুচ্ছ ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

তারা এমন সব খুঁটিনাটি, অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, যেগুলোয় তারা এত শক্তি খরচ করে যে তা দিয়ে দিনের পর দিন কঠিন শ্রমসাধ্য কাজ করা যেতো।


কিন্তু ফলাফল?

শেষে দেখা যায়, কিছুই অর্জিত হয়নি।

শক্তি গেছে, সময় গেছে, মন গেছে—কিন্তু কোনো বাস্তব কাজ এগোয়নি।


এই উদাহরণ আমাদের শেখায়—উদ্যম যথেষ্ট নয়, তাকে দিশা দিতে হয়, কেন্দ্র করে রাখতে হয়, আর তার সঙ্গে জুড়তে হয় এক অদম্য সংকল্প।

এটাই সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল পার্থক্য।

এটাই শক্তি ও দুর্বলতার সীমারেখা।


মনে রাখবেন—


আপনার মনের গভীরে রয়েছে এক অসীম শক্তি—যেটি জাগ্রত হলে আপনিও “সাধারণ” থেকে “অসাধারণ” হয়ে উঠতে পারেন।

আপনার ভিতরেই রয়েছে সেই উপাদান, যেটা দিয়ে সফল ব্যক্তিরা গঠিত।

তাদের শ্রেষ্ঠত্ব তাদের উপকরণে নয়—তাদের বিশ্বাসে, দৃঢ় সংকল্পে ও সদ্ব্যবহারে।


এবং আপনার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে সেই উৎস—শুধু জাগিয়ে তোলার অপেক্ষা।

সেই জাগরণই আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে মহানতার পথে।


অন্য অনেকেই আছেন, যাদের উদ্যমের অভাব নেই—তবু তাঁরা সেই উদ্যমকে ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত করতে পারেন না।

এইখানেই এসে দাঁড়ায় সেই অতিমানবীয় শব্দদ্বয়:

“অদম্য সংকল্প”—

এই শব্দগুলো কি আপনাকে এক শক্তির শিহরণে ভরিয়ে তোলে না?


আপনার যদি কিছু করণীয় থাকে, তবে উঠে পড়ুন—কাজে লেগে পড়ুন।

আপনার সমস্ত শক্তিকে একত্র করুন, তারপর ইচ্ছাশক্তির রাশে টেনে নিয়ে যান তাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে।

তার গায়ে ছাপ দিন সেই “অদম্য সংকল্প”—তাহলেই আপনি সফল হবেন।


প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে এক দৈত্যসম ইচ্ছাশক্তি, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এতটাই অলস যে তারা সেই শক্তিকে ব্যবহার করে না।

আমরা নিজেদের এমন এক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারি না, যেখানে স্পষ্টভাবে, দৃঢ় কণ্ঠে বলা যায়:

“আমি করব!”

যদি একবার আমরা সাহস করে এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি—

আর সেই অবস্থানটিকে সুরক্ষিত রেখে, পিছনে না হটিয়ে রাখতে পারি,

তবে আমরা জাগিয়ে তুলতে পারব সেই অসাধারণ শক্তিকে—

“মানব ইচ্ছাশক্তি”কে।


সাধারণত মানুষ ইচ্ছাশক্তির প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে খুবই সামান্য ধারণা রাখে।

কিন্তু যারা গূঢ় জ্ঞান বা আত্মপ্রবৃত্তির সাধনায় মন দিয়েছে, তারা জানে—

ইচ্ছাশক্তি এই মহাবিশ্বের অন্যতম এক প্রবল গতিশীল শক্তি,

যা যদি ঠিকভাবে রাশে বাঁধা যায় ও সঠিকভাবে চালিত করা যায়, তবে

প্রায় অলৌকিক কীর্তিও সম্পাদন করতে পারে।


“উদ্যম ও অদম্য সংকল্প”—এই শব্দ দুটো কি শুধুই শব্দ?

না, এগুলো একেবারে মহাকাব্যিক শ্লোকের মতো—

এই শব্দ দুটোকে আপনার স্মৃতিতে গেঁথে ফেলুন,

মনের মোমে গভীর ছাপ ফেলুন তাদের,

তাহলেই তারা হয়ে উঠবে আপনার অনুপ্রেরণার উৎস, ঠিক সেই মুহূর্তে যখন আপনার সবচেয়ে বেশি দরকার।


যদি আপনি এই শব্দগুলোকেই নিজের প্রাণে স্পন্দিত করতে পারেন,

তবে আপনি বামনদের ভিড়ে এক দৈত্যের মতো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন।

এই শব্দগুলোকে বারবার উচ্চারণ করুন,

দেখবেন কীভাবে আপনার ভিতরে নতুন প্রাণ জেগে ওঠে—

রক্ত সঞ্চালন ত্বরান্বিত হয়, স্নায়ুতে জোরাল তরঙ্গ খেলে যায়।


এই শব্দদ্বয়কে নিজের অস্তিত্বের অংশ করে তুলুন,

তারপর জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন উদ্যমে পা রাখুন—

উৎসাহ ও শক্তিতে পূর্ণ হয়ে।


এই শব্দগুলোকে শুধু মুখে নয়, কাজে প্রয়োগ করুন—

“উদ্যম ও অদম্য সংকল্প”—

এই হোক আপনার নিত্যদিনের জীবনের মূলমন্ত্র।

তাহলেই আপনি হবেন সেই বিরল কিছু মানুষের একজন,

যারা সত্যিই কাজ করে দেখায়।


তবে, অনেক মানুষ তাদের সেরা দিকটি প্রকাশ করতে পারে না—

কারণ, তারা নিজেদের খাটো করে দেখে,

অথবা, জীবনের সফল মানুষদের অতিরিক্ত বড় করে দেখে।


এটা খুবই মজার বিষয়,

যখন আপনি কাছ থেকে সেই “সফল” মানুষদের দেখেন—

যাদেরকে সমাজ “উল্লেখযোগ্য” বলে মনে করে—

তখন আপনি প্রায়ই বিস্মিত হন এই দেখে যে,

তারা এতটাও “অসাধারণ” নন।


আপনি হয়তো ভাবতেন, এক বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে দেখা হবে তো তিনি ঝলমলে, মেধাবী কথোপকথনে আপনাকে অভিভূত করবেন।

কিন্তু দেখা যায়, তিনি খুবই সাধারণ কথা বলেন—

প্রকৃতপক্ষে, আপনি অনেক “অসফল” মানুষের চেয়ে তাঁকে কম উজ্জ্বল বলে মনে করেন।


একজন বিখ্যাত রাজনীতিকের সঙ্গে দেখা হলে আপনি হয়তো আশা করতেন মহান বুদ্ধির ঝলক,

কিন্তু তখন আপনি ভাবেন, “আরে, আমাদের গ্রামের বুড়ো মশাই অনেক বেশি বুদ্ধিমান—শুধু তাঁর কথাগুলো কেউ শোনে না!”


একজন ধনকুবের শিল্পপতির সঙ্গেও দেখা হতে পারে,

কিন্তু দেখা যায়, তাঁর মাঝে সেই সূক্ষ্ম চতুরতা আপনি খুঁজে পান না—

যেটা হয়তো আপনার চেনা এক ক্ষুদে দোকানদারের মধ্যে আছে,

যিনি দর-কষাকষিতে অদ্বিতীয়।


তাহলে ব্যাপারটা কী?

এই বিখ্যাতদের নাম-ডাক কি মিথ্যা?

না কি অন্য কোনো রহস্য আছে?


এটাই প্রশ্ন…

আর তার উত্তর আপনি শীঘ্রই জানবেন।

তবে এটুকু এখনই বলা যায়:

তারা “অসাধারণ” হয়নি কারণ তারা ভিন্ন রকম মানুষ ছিল—

তারা নিজেদের সেই “অদম্য সংকল্প” দিয়ে গড়ে তুলেছে সেই অসাধারণতাকে।

এবং এই শক্তি—এই ইচ্ছা—এই দৃষ্টি—

আপনার মধ্যেও আছে।

শুধু তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।


সমস্যাটা ঠিক কোথায়?

আপনি এই মানুষগুলোর কথা ভাবেন এমনভাবে, যেন তারা কোনো উচ্চতর ধাতব পদার্থে গঠিত—

আর যখন দেখেন তারা ঠিক আপনার মতোই রক্ত-মাংসে গড়া, তখন আপনি হতাশ হয়ে পড়েন।

কিন্তু আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, তবে তাদের সেই “মহান কীর্তির” গোপন রহস্যটা কোথায়?

তবে এর উত্তর সংক্ষেপে এই—


তারা নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখে।

তারা বিশ্বাস রাখে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সামর্থ্যের উপর।

তারা জানে কীভাবে বর্তমানে যা করছে, তার উপরে মনোযোগ স্থাপন করতে হয়,

আর কীভাবে অপ্রয়োজনীয় শক্তি অপচয় বন্ধ রাখতে হয়, যখন তারা কাজ করছে না।


তারা নিজেদের বিশ্বাস করে, এবং প্রতিটি প্রয়াসকে অর্থবহ করে তোলে।


আপনার গ্রামের সেই "জ্ঞানের আধার" বুড়ো মশাই তাঁর জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছেন রাস্তার মোড়ে মোড়ে,

আর বলছেন এমন সব মানুষের সাথে, যারা তাঁর কথার মূল্য দিতে জানে না।

যদি তিনি সত্যিই জ্ঞানী হতেন, তবে এই জ্ঞানকে সঞ্চয় করে যথার্থ স্থানে কাজে লাগাতেন।


একজন খ্যাতিমান লেখক প্রতিদিনকার কথোপকথনে নিজের বুদ্ধির ঝলক নষ্ট করেন না।

তিনি তাঁর বুদ্ধির দারাজ বন্ধ করে রাখেন—

শুধু তখনই খুলে দেন, যখন কেন্দ্রিতভাবে কাজ করতে প্রস্তুত হন।


একজন সফল শিল্পপতি আপনার সামনে নিজের বুদ্ধি বা শানদারিত্ব দেখাতে আগ্রহী নন।

তিনি যখন তরুণ ছিলেন তখনও ছিলেন না।


তাঁর বন্ধুরা যখন আড্ডা দিচ্ছে, গল্প করছে, আত্মপ্রশংসায় মত্ত—

তখন ভবিষ্যতের এই শিল্পপতি চুপচাপ কাঠ কেটে যাচ্ছেন, আর মুখে বলছেন—"কিছু না।"

(“Sawin' wood and sayin' nuthin'.”)


এই পৃথিবীর সত্যিকার “মহান” মানুষগুলো—

অর্থাৎ যারা সত্যি সফল হয়েছে,

তারা আমাদের, আপনার, বা আশেপাশের মানুষের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়।

আমরা সবাই একই মূল উপাদানে গঠিত।


আপনি যদি কখনো তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন,

তবে অবাক হয়ে দেখবেন—তারা আসলে কতটা “সাধারণ”!

কিন্তু একটি জিনিস ভুলবেন না—

তারা জানে কীভাবে নিজেদের ভেতরের উপাদানগুলোকে কাজে লাগাতে হয়।

অন্যদিকে, সাধারণ মানুষরা তা করে না, বরং

সন্দেহ করে—আসলে আদৌ কিছু আছে কিনা, নিজের ভেতরে!


যে মানুষটি "সফলতা অর্জন" করে,

সে সাধারণত এই উপলব্ধি দিয়ে শুরু করে—

"আমি মোটেই এতটা ভিন্ন নই, এইসব সফল মানুষদের তুলনায়।"


এই অনুভব থেকেই জন্ম নেয় আত্মবিশ্বাস,

আর আত্মবিশ্বাস থেকেই আসে কর্মক্ষমতা।


তারপর তারা শেখে—

কীভাবে মুখ বন্ধ রাখতে হয়,

কীভাবে শক্তি অপচয় এড়াতে হয়।

তারা শক্তিকে জমা রাখে,

এবং সেই সঞ্চিত শক্তিকে প্রয়োগ করে নির্দিষ্ট কাজে।


অন্যদিকে, যাঁরা ব্যর্থ হয়ে পড়ে, তারা নিজেদের শক্তিকে

সব দিকেই ছড়িয়ে দেয়,

নিজেদের বুদ্ধিমত্তা প্রমাণ করতে চায়,

এবং লোককে দেখাতে চায়—“আমি কত বুদ্ধিমান!”


কিন্তু যে ব্যক্তি সত্যিকারের সাফল্যের পথে চলে,

সে অপেক্ষা করে কর্ম-সম্পন্ন হবার পর আসা প্রশংসার জন্য।

তার মাথাব্যথা নেই সেইসব লোকদের মতো—

যারা শুধু বলেই যায়,

“আমি একদিন কিছু করব”—কিন্তু কিছুই করে না।


সে অপেক্ষা করে, কারণ সে জানে—

“মেধার প্রদর্শনী নয়, কর্মই শেষ কথা।”

আর এই উপলব্ধিই তাকে করে তোলে এক অসাধারণ সাধারণ মানুষ।


এবং আপনি, আমিও—

আমরাও পারি সেই পথ ধরতে,

যদি শুধু আমরা নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখতে শিখি।


অনেক সময় দেখা যায়, কেউ যদি কোনো সফল মানুষের সংস্পর্শে আসে, তাহলে সেও ধীরে ধীরে সাফল্যের পথে এগিয়ে যায়।

এটা কেন হয়? কারণ সে সফল মানুষটিকে কাছ থেকে দেখে,

তার কাজের ধরন, ভাবনার ধারা, ও সাফল্যের “চালাকি” বা কৌশল একরকম বুঝে নিতে পারে।


সে দেখে, এই মানুষটিও একেবারে আমাদের মতো সাধারণই,

তবে তার মধ্যে রয়েছে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস,

আর সে অপচয় করে না নিজের শক্তির—

বরং নিজের সমস্ত শক্তিকে সংরক্ষণ করে রাখে বাস্তব কাজের জন্য।


এভাবে সে উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে,

নিজের জীবনেও সেই পাঠ প্রয়োগ করতে শুরু করে।

এই আলোচনার মূল শিক্ষা কী?


খুব সহজ:

নিজেকে ছোট করে দেখো না, আর অন্যদের অতিরিক্ত বড় করে তুলো না।


এই উপলব্ধি রাখো যে, তুমি ভালো উপাদানেই গঠিত,

এবং তোমার মনের গভীরে অনেক মহৎ সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে।


এখনই কাজে নেমে পড়ো।

তোমার মধ্যে যে ভালো জিনিসগুলো আছে,

সেগুলোকে ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত করো,

আর সেই “ভালো উপাদান” দিয়ে কিছু মূল্যবান সৃষ্টি করো।


এটা করতে পারো কীভাবে?


👉 তোমার চোখের সামনে যে কাজটা এখন আছে,

তাতে পুরো মনোযোগ দাও।

👉 তার জন্য দাও তোমার ভিতরের সর্বোত্তমটা,

এই বিশ্বাস রেখে যে,

তোমার মধ্যে আরও বহু ভালো জিনিস অপেক্ষা করে আছে

আগামী দিনের নতুন কাজগুলোর জন্য।


তোমার মধ্যে যতটা ভালো আছে,

তা এই মুহূর্তের কাজে ঢেলে দাও—

ভবিষ্যতের সম্ভাবনার জন্য বর্তমানকে ঠকিও না।


তোমার ভিতরের সেই "ভালো উপাদান" একেবারে অফুরন্ত।


আর একটা কথা—

এই ভালো জিনিসগুলো অপচয় কোরো না,

তাদের জন্য যারা শুধুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে,

তোমার কাজ দেখে শুধু দর্শক হয়ে থাকে।


👉 তোমার শক্তিকে বাঁচাও তোমার কাজের জন্য—

👉 বেশি তাড়াহুড়ো কোরো না বাহবা পাওয়ার জন্য।


তুমি যদি লেখক হও,

👉 তাহলে তোমার ভালো চিন্তাগুলো “কপি”-র জন্য জমিয়ে রাখো।

তুমি যদি ব্যবসায়ী হও,

👉 তাহলে তোমার উজ্জ্বল পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য তুলে রাখো।

তুমি যদি রাজনীতিক হও,

👉 তাহলে তোমার প্রজ্ঞা তুলে রাখো সঠিক সময়ের জন্য।


আর যেকোনো ক্ষেত্রেই, চেষ্টা করো এই “উৎসুক ভিড়ের” সামনে নিজেদের সব কিছু ছড়িয়ে না দিতে।

সব জিনিস “ফ্রি শো” বানিয়ে দিলেই, তার মূল্য আর থাকে না।

হয়তো এই শিক্ষাগুলো খুব একটা “উঁচুমানের” নয় বলেই মনে হতে পারে,

কিন্তু এই কথাগুলোরই এখন তোমার বড় প্রয়োজন।


ধোঁকা-ধাঁধা ছেড়ে এখন সত্যিকারের কাজে নামো।

তোমার ভিতরের সেই অমূল্য কাঁচামাল আর নষ্ট কোরো না—

তাকে রূপ দাও—

একটি এমন কিছু তৈরি করো, যার আসলেই মূল্য আছে।

এটাই হোক তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ।


অধ্যায় ১৫: নিজের প্রাপ্য দাবি করো

(Claiming Your Own)


"আমার জন্য এত ভালো কিছু? না, এটা আমার প্রাপ্য নয়।"

—এই কথাটি আমরা কতবার বলেছি নিজের মনে?

তবে জানো, এই কথাটি তোমার পথের সবচেয়ে বড় বাধা?


সম্প্রতি আমি এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলাম।

তিনি বহু বছর ধরে এক বিশেষ আনন্দ, এক কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের স্বপ্ন দেখে আসছিলেন—

আর এখন সেটা তাঁর চোখের সামনে, একেবারে নাগালের মধ্যে।


তবুও তিনি বলছিলেন,

"না, এটা সত্যি হতে পারে না… এটা আমার পক্ষে খুব ভালো…!"

তাঁর মনে ছিল ভয়, ছিল আত্ম-অবিশ্বাস, আর ছিল সেই পুরনো অনুভব—

"আমি ধুলো-মাটির কীট, এত ভালো কিছু আমার কপালে হয় না!"


যেন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেই “প্রতিশ্রুত ভূমি”-তে পা রাখবেন না—

কারণ সেটি “তাঁর যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি”!


আমি তাঁকে সাহস দিয়েছিলাম, নিজেকে দাবি করার জন্য।

আর পরে খবর পেলাম, তিনি সত্যিই সেই প্রাপ্য আনন্দটিকে গ্রহণ করেছেন।


কিন্তু আজ আমি তোমাকে সেই কথাটাই বলতে চাই—

"তোমার জন্য কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়।"

যত বড় স্বপ্ন হোক, যত বড় সাফল্য—তুমি তারই উপযুক্ত।

তুমি তার যোগ্য, কারণ এটি তোমার ‘অধিকারসূত্রে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার’।


👉 তাই ভয় পেও না।

👉 চাও—দাবি করো—আর গ্রহণ করো।


পৃথিবীর সকল ভাল জিনিস কোনো বিশেষ মানুষদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়।

তারা সবার জন্য, কিন্তু তারা কেবল তাদের কাছেই আসে—

যারা যথেষ্ট জ্ঞানী, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলতে পারে,

“এগুলো আমার প্রাপ্য।”


অনেক ভালো জিনিস আমাদের কাছে আসে না—

কেন?

👉 কারণ আমরা চাই না।

👉 কারণ আমরা মনে করি, “আমি তো ওর মতো নই।”

👉 কারণ আমরা সাহস পাই না নিজের জন্য বড় কিছু দাবি করতে।


"শুধু সাহসীরাই প্রিয়তমার প্রাপ্য"—

পুরনো প্রবাদ, কিন্তু এখনো সত্য।


যদি তুমি নিজেকে বলে যাও,

“আমি অযোগ্য… এতটা ভালো কিছু আমার জন্য নয়”,

তবে এই মহাজাগতিক নিয়ম—এই ‘Law’—তোমাকে বিশ্বাস করে ফেলবে।


এই নিয়ম বড়ই বিচিত্র—

👉 সে তোমার কথা বিশ্বাস করে।

👉 সে তোমার বিশ্বাসকেই বাস্তব করে তোলে।


তাই সাবধান! কী বলছো, কী ভাবছো—তার প্রতি সচেতন হও।


নিজেকে বলো:

“আমি সেরাটারই যোগ্য। আমার জন্য কিছুই অতিরিক্ত নয়।”

👉 দেখবে, সেই নিয়মও বলবে:

“এই মানুষটা জানে সে কী চায়, সে তার প্রাপ্য দাবি করতে জানে—চলো, সবটুকুই তাকে দিই!”


কিন্তু যদি তুমি নিজেকে বলো:

“না, এটা আমার জন্য নয়, আমার কপালে নেই”—

তবে সেই নিয়মও উত্তর দেবে:

“হুঁ, সে যা বলছে ঠিকই তো, আমি তো ওকে বিরোধিতা করতে পারি না।”


এইভাবে তোমার নিজস্ব সম্ভাবনা থেকে তুমি নিজেই দূরে সরে যাও।


তুমি এই মহাবিশ্বেরই একটি পূর্ণ প্রকাশ,

তোমার ভেতরে আছে সেই সমগ্রের শক্তি—

আর সেই শক্তির কাছ থেকে কিছু দাবি করা মানে নিজের প্রাপ্যটাই গ্রহণ করা।


তাই নিজেকে আর অবমূল্যায়ন কোরো না।

তোমার প্রাপ্যকে ভয় কোরো না।

দাবি করো—গর্বভরে, সাহসের সঙ্গে, বিশ্বাস নিয়ে।


কারণ এই মহাবিশ্বের বহু মহৎ জিনিস অপেক্ষা করছে,

তোমার ‘যোগ্য হওয়ার’ ঘোষণার অপেক্ষায়।

সেই ঘোষণা আজ করো—নিজেকে জাগাও,

আর বলো: “এটা আমার প্রাপ্য—আমি এটা গ্রহণ করতে এসেছি।”


অধ্যায় ১৫-এর পরবর্তী অংশ: নিজের প্রাপ্য দাবি করো (Claiming Your Own)

(বাংলা রূপান্তর—গভীর, শিল্পিত ও প্রেরণামূলক শৈলীতে)


তুমি কি কখনো থেমে ভেবে দেখেছো,

"আমার জন্য কিছু খুব ভালো হতে পারে না কেন?"

ভেবে দেখো—তুমি আসলে কে?


তুমি এই মহাবিশ্বের এক পূর্ণ প্রকাশ—এক স্বয়ম্ভর অভিব্যক্তি।

অথবা, যদি তুমি এভাবে ভাবতে স্বচ্ছন্দ হও—

তুমি অসীম শক্তির সন্তান, আর তার উত্তরাধিকারী।


👉 তুমি যেভাবেই বলো না কেন—দুইভাবেই তুমি সত্য বলছো।


যা কিছু তুমি চাও—যা কিছু তোমার হৃদয় লালন করে—

সেই চাওয়া তোমার নিজের চাওয়া,

তুমি অন্য কারো কিছু চাইছো না—তুমি কেবল নিজের প্রাপ্যই দাবি করছো।


আর তুমি যত বেশি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হবে,

তত বেশি তুমি নিজের ইচ্ছাকে কাজে লাগাতে পারবে,

আর ততটাই নিশ্চিতভাবে তুমি সেই প্রাপ্য জিনিসটি অর্জন করবে।

তোমার চাওয়াকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য তিনটি উপাদান চাই—

তীব্র আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাসপূর্ণ প্রত্যাশা, আর সাহসী কর্ম।


তবে এগুলোর আগে চাই একটা অভ্যন্তরীণ জাগরণ—

👉 একটা বোঝাপড়া যে তুমি "অন্য কারো কিছু চাচ্ছো না",

👉 তুমি চাচ্ছো যা তোমার—তোমার প্রকৃত অধিকার।


যতক্ষণ তোমার মনে সামান্যতম সন্দেহ থাকবে যে

“এই জিনিসটা আমার নয়,”

ততক্ষণ তুমি নিজের ইচ্ছাকে পূর্ণ শক্তিতে ব্যবহার করতে পারবে না।

👉 তোমার ভিতরেই তখন তৈরি হবে এক অদৃশ্য প্রতিরোধ,

👉 আর সেই প্রতিরোধে বাধা পড়বে মহাজাগতিক নিয়মের কাজ।


ধরে নাও, তুমি কোনো কিছু চাচ্ছো, কিন্তু মনে মনে ভাবছো—

"এটা কারো অন্যের প্রাপ্য… এটা আমি চেয়ে নিচ্ছি…"

তবে জানো, তোমার মনের সততা এই ধারণাকে মেনে নেবে না।


👉 কারণ তোমার মনের গভীরে বাস করে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি এক স্বাভাবিক শ্রদ্ধা।

👉 তুমি অনুভব করবে যেন চুরি করে কিছু নিচ্ছো, আর তোমার মনের ভেতরেই সৃষ্টি হবে এক বিরুদ্ধতা।


কিন্তু, যদি তুমি সত্যিই বুঝে ফেলো—

এই জগতের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলোই তোমার জন্য,

তোমার বিকাশের জন্য, আনন্দের জন্য, সন্তুষ্টির জন্য…

আর সেই জিনিসগুলো অন্য কারো কাছ থেকে কেড়ে নিতে হচ্ছে না—

কারণ এই মহাবিশ্বে সবার জন্য যথেষ্ট আছে…


👉 তখন, তোমার ভিতরের বাধাগুলো দূর হবে,

👉 আর মহাজাগতিক নিয়মও কাজ করতে পারবে নিরবিচারে।

আমি ভুয়া বিনয় বা কৃত্রিম নম্রতার কোনো মূল্য দেখি না।

এই "আমি তো কিছুই নই", "আমি তুচ্ছ", "আমি অযোগ্য"—

এসব মানসিকতা একধরনের আত্ম-হিপনোসিস—

যা তোমাকে তোমার নিজস্ব শক্তির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।


👉 তুমি কি মহাবিশ্বের উত্তরাধিকারী হয়েও

নিজেকে একটা কীটজীব ভাববে?

👉 তুমি কি তোমার সমস্ত সম্ভাবনার দরজাগুলো বন্ধ করে রাখবে এই ভেবে—

"আমি এমন কিছু পাওয়ার যোগ্য নই?"


না, না, বন্ধ করে দাও এই মিথ্যা নম্রতার খেলা।

আমি বলছি না তুমি গর্জন করে, দাম্ভিক হয়ে ওঠো—

সেইরকম অহংকারও একটা দুর্বলতার চিহ্ন।

👉 আসল শক্তি থাকে শান্ত, দৃঢ় ও সুসংহত ভিতরের আত্মবিশ্বাসে।

তোমার মাথা তুলে ধরো।

জগৎকে চোখে চোখ রেখে চেয়ে দেখো।

👉 দুনিয়াটা তোমার থেকে খুব একটা শক্তিশালী নয়—

বস্তুত, দুনিয়াটাও প্রায়শই তোমাকে দেখে ভয় পায়।


তুমি পুরুষ হও, নারী হও—কিন্তু কখনো ‘হাঁটুপড়া প্রাণী’ হয়ে থেকো না।


👉 তোমার বাহ্যিক চালচলনের মতোই

তোমার মানসিক ভঙ্গিমাটাও হোক দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী ও সম্মানজনক।


নিজেকে কুঁকড়ে যাওয়া পাতার মতো কল্পনা করা বন্ধ করো।

👉 কল্পনা করো—তুমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছো,

👉 সাহসের সাথে জীবনকে দেখছো,

👉 আর ধীরে ধীরে তুমি তোমার সেই মহৎ রূপে নিজেকে গড়ে তুলছো।

কারণ তুমি কিছু বড় দাবি করছো না—

তুমি কেবল নিজেকে গ্রহণ করছো—তোমার প্রাপ্যটুকু চাচ্ছো।

এবং যে নিজেকে জানে—সে-ই সত্যিকারের শক্তিশালী।


অধ্যায় ১৫-এর সমাপ্তি: নিজের প্রাপ্য দাবি করো (Claiming Your Own)

(বাংলা রূপান্তর—দার্শনিক, অনুপ্রেরণামূলক ও মমতাময় কণ্ঠে)


এই জগতে এমন কিছু নেই—যা তোমার জন্য ‘অত্যধিক ভালো’।

👉 এই জগতের সেরা জিনিসটাও—তোমার প্রাপ্যের সামান্য ছায়া মাত্র।

👉 কারণ, এখনো সামনে রয়েছে আরও বিস্ময়কর, আরও মহত্তর সম্ভাবনা—

তোমার ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হওয়ার অপেক্ষায়।


বিশ্ব তোমাকে যে শ্রেষ্ঠ উপহার দিতে পারে,

তা কেবল একটা ছোট খেলনা—

এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডের গোপন ভাণ্ডারে যেসব অমূল্য রত্ন লুকিয়ে আছে,

সেগুলোর তুলনায় তা কিছুই না।


তাই ভয় পেয়ো না—

এই জীবনের খেলনার দোকান থেকে যা কিছু তোমার চোখে পড়ে,

👉 চাইলেই হাত বাড়াও,

👉 এক মুঠো নিয়েই খেলো,

👉 যতক্ষণ খুশি খেলো,

কারণ এই খেলনাগুলো ঠিক সে কাজের জন্যই তৈরি হয়েছে।


এগুলো তৈরি হয়েছে আমাদেরই ব্যবহারের জন্য—

শুধু তাকিয়ে দেখার জন্য নয়,

👉 চাইলে খেলো,

👉 ভালোবাসলে উপভোগ করো,

👉 আর প্রয়োজন হলে ঝুলিতে পুরে রাখো।


এই ব্রহ্মাণ্ড একটা বিশাল দোকান—

তুমি যা চাও, তা দাবি করো—

👉 না কুণ্ঠা নিয়ে,

👉 না হীনম্মন্যতায়,

👉 না কোনও “আমি কি এত ভালো কিছু পাবার যোগ্য?”-জাতীয় মনোভাব নিয়ে।


এখন থেকে আর কোনো কান্না শুনতে চাই না,

যে ‘এই জিনিসটা আমার পক্ষে অতিরিক্ত ভালো’।


হ্যাঁ, তুমি অনেকটা সেই সম্রাটের ছোট ছেলের মতো—

যে কিনা রূপোর টিন-সোলজার আর ছোট ঢাক দেখে ভয় পেয়েছিল—

ভাবছিল, “এসব তো আমার জন্য নয়!”

👉 তাই সে এগিয়ে হাত বাড়াল না।


কিন্তু তুমি দেখো, ছোট শিশুরা সাধারণত এমন করে না।

তারা স্বাভাবিকভাবেই জানে—

👉 এ জগতে কিছুই তাদের জন্য খুব বেশি নয়।

👉 তারা চায় সবকিছু—

👉 তারা খেলে, হাসে, চায়, দাবি করে—

তাদের মনে হয়, সবকিছুই যেন তাদের প্রাপ্য।


এবং ঠিক এই মনোভাবটাই

আমাদের—যারা এই মহাজাগতিক অভিযানে এগিয়ে চলেছি আমাদের নিজেদের মধ্যে লালন করতে হবে।


👉 কারণ যতক্ষণ না আমরা শিশুর মতো হয়ে উঠতে পারি,

👉 ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা “স্বর্গরাজ্যে” প্রবেশ করতে পারি না।


এখানে স্বর্গ মানে কোনো অদূর ভবিষ্যতের জায়গা নয়,

👉 বরং সেই চেতনার রাজ্য—

যেখানে তুমি বুঝে ফেলো,

এই সম্পূর্ণ জগৎ তোমারই,

তুমি কোনো কিছু ধার করছো না,

তুমি কেবল নিজেকে আবিষ্কার করছো।

সুতরাং, ভয় দূর করো।

হাত বাড়াও।

চেয়ে নাও।

নিজের ভালোবাসা দিয়ে স্পর্শ করো।

এবং খেলো, খেলো যতক্ষণ প্রাণ চায়।


কারণ তুমি ছোট কিছু নও।

তুমি এই মহাবিশ্বের এক মহৎ উত্তরাধিকারী।

নিজেকে ছোট ভাবা এই মহাজাগতিক সত্যের অপমান।


তুমি যা চাও—তা তোমার—এটাই সত্য।

এখন শুধু দরকার বিশ্বাস, স্পর্ধা আর নির্ভয়তা।

তাহলেই তুমি পাবে, যা তোমার চিরদিনের প্রাপ্য। 🌟


অধ্যায় ১৫-এর অন্তিমাংশ: ঈশ্বরের কিন্ডারগার্টেনের খেলাঘর

(বাংলা অনুবাদ—দার্শনিক, কোমল ও শক্তিশালী ভঙ্গিতে)


আমরা চারপাশে যা কিছু দেখি—

👉 এ সবই ঈশ্বরের কিন্ডারগার্টেনের খেলনা।

এই জীবনের খেলাঘরে আমরা সবাই শিশু,

আর এই খেলনাগুলো—আমাদের খেলার উপকরণ।


নিজেকে সাহায্য করো—

চেয়ে নাও যা কিছু দরকার।

লজ্জা পেও না।

👉 দাবি করো—যতটা ব্যবহার করতে পারো।

এগুলো তোমারই জন্য।


আর যদি ঠিক যেটা চাও সেটা দেখতে না পাও—

👉 তাহলে জিজ্ঞেস করো।

👉 জানো তো, শেলফ আর আলমারিগুলোতে

রিজার্ভ স্টকে এখনও অনেক কিছু রাখা আছে!

এই জীবনের খেলনাগুলো দিয়ে মন খুলে খেলো,

মনের আনন্দে।


👉 ম্যাট বুনো,

👉 ব্লকে ঘর গড়ো,

👉 স্কোয়ারে নকশা সেলাই করো—

খেলো এই জীবনখেলা, এবং খেলো মনপ্রাণ দিয়ে।


আর হ্যাঁ—

যে খেলাগুলোর জন্য খেলছো,

সেই উপকরণগুলো চাও।

আরও চাও। নির্দ্বিধায় চাও।

👉 কারণ, পর্যাপ্ত আছে সবার জন্য।


কিন্তু একটা কথা মনে রেখো—


যদিও এ সব সত্য,

👉 তবুও এগুলো কেবল “খেলনা”—

👉 এই পৃথিবীর সাময়িক শিক্ষার যন্ত্র।


এগুলো খুবই কার্যকরী—

👉 শেখার জন্য,

👉 আনন্দের জন্য,

👉 জীবনের পাটে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য।

তবে—

👉 এগুলোর সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ো না,

👉 যেন এগুলো ছাড়া তুমি নিজেকে কল্পনাই করতে পারো না।


👉 যখন সময় আসবে ‘পরবর্তী শ্রেণিতে’ উত্তরণের,

তখন এই খেলনাগুলো হেসে-হেসে মাটিতে ফেলে রেখে

তোমাকে চলে যেতে হবে।

আঁকড়ে থাকো না। কান্না কোরো না।


👉 এগুলো তোমার অংশ নয়—

তোমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য কিছু নয়।


👉 এগুলো ব্যবহার করো, উপভোগ করো—

কিন্তু এগুলো যেন তোমাকে ব্যবহার না করে।


👉 তোমার দাসত্ব যেন খেলনাগুলো দাবি না করে।


এখানেই পার্থক্য—

👉 পরিস্থিতির প্রভু (Master of Circumstances)

আর

👉 পরিস্থিতির দাস (Slave of Circumstances) এর মধ্যে।


পরিস্থিতির দাস ভাবে—

👉 এই খেলনাগুলোই আসল জিনিস।

👉 আর সে নিজে এদের যোগ্য নয়।

👉 তাই সে মাত্র কয়েকটা খেলনাই নেয়, ভয় পায় বেশি চাইতে।


আর এই দু–একটা খেলনাকেই আঁকড়ে ধরে রাখে,

ভাবতে থাকে, “এগুলোই সব। আর কিছু পেলে হয়তো হারাবো এগুলো।”


অন্যদিকে পরিস্থিতির প্রভু জানে—

👉 সবকিছুই তার জন্য অপেক্ষমাণ—

👉 শুধু চাওয়ার অপেক্ষা।


👉 সে প্রতিদিন যা দরকার—দাবি করে, গ্রহণ করে।

👉 সে খেলায় মেতে ওঠে প্রাণভরে।

👉 শেখে, হাসে, গড়ে তোলে নিজেকে।


কিন্তু সে একটা খেলনাতেও অতিরিক্তভাবে জড়িয়ে পড়ে না।

👉 একটার প্রয়োজন ফুরোলেই ছেড়ে দেয়,

👉 নতুনটার দিকে হাত বাড়ায়।


আর যখন ডাক পড়ে পরবর্তী শ্রেণির,

👉 সে পেছনে ফেলে দিনের পুরনো খেলনাগুলো—

👉 চোখে জ্যোতি, মুখে হাসি নিয়ে

চলে যায় নতুন ঘরে—

👉 অজানার মধ্যে নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে।


কারণ সে শুনতে পায় শিক্ষকের কণ্ঠস্বর—

জানে, তিনি অপেক্ষা করছেন তার জন্য

ঐ মহাসারগর্ভ নতুন কক্ষে।


এটাই সত্যিকারের মুক্তি।

এটাই আত্মজয়।

এটাই “আমি কে”—তা জানার প্রশিক্ষণ।


তাই, খেলো—

তবে খেলনাকে দাসত্ব দিও না।

চাইলে চাও—

তবে জানো, সবটাই তোমার শেখার পথের অংশমাত্র।


শেষ পর্যন্ত, তুমি ঈশ্বরের স্কুলঘরের সেই শিশু—

যার জন্য সৃষ্টিসমগ্র অপেক্ষা করে আছে। 🌟


অধ্যায় ১৬: নিয়ম, নয় ‘দুর্ভাগ্য’

(বাংলা অনুবাদ — গভীর, সহজ ও আত্মবিশ্বাস-জাগানো ভাষায়)


ভাবনার আকর্ষণশক্তি নিয়ে কিছুদিন আগে আমার এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল।

তিনি বললেন— “না, এসব আমি মানি না।

ভাবনা কিছুই টানে না। সবই ভাগ্যের ব্যাপার।

আমার জীবনে তো দেখি শুধু দুর্ভাগ্যই পেছনে লেগে আছে।

আমি যা-ই করি, সব উল্টে যায়।”


বললেন,

“সবসময়ই এমন হয়েছে, সবসময়ই এমন হবে।

এমনকি কিছু নতুন কাজ শুরু করলেও

আমি আগেই বুঝে যাই যে ওটা বিফলে যাবে।

আমি জানি, ভালো কিছু হবে না।

সোজা কথা— এসব আকর্ষণের নিয়ম-টিয়ম সব ফালতু।

এটা সবই ভাগ্যের খেলা!”


❖ কিন্তু মজার ব্যাপার?

এই লোকটি নিজের অজান্তেই ‘আকর্ষণের নিয়ম’ (Law of Attraction)-এর সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ দিয়ে বসেছিল।


🔹 সে নিজে স্বীকার করছিল

সে সবসময় খারাপ কিছু আশা করে,

আর ঘটনাগুলো ঠিক সেইভাবেই ঘটে!


🔹 মানে, সে নিজেই প্রমাণ দিচ্ছিল

যে আমরা যা ভাবি, যেভাবে ভাবি,

জীবনকে অনেকাংশে ঠিক সেভাবেই গড়ে তুলি।


কিন্তু তার দৃষ্টিতে, এটা কোনও নিয়ম নয়—

এটা কেবল দুর্ভাগ্য।


❖ অনেকেই মনে করে,

“আকর্ষণের নিয়ম” কাজ করে শুধুমাত্র তখনই

যখন কেউ খুব জোরে, মনপ্রাণ দিয়ে কিছু চায়।


কিন্তু তারা বোঝে না—

👉 একটা প্রবল বিশ্বাস

একটা প্রবল ইচ্ছার চেয়েও সমান কার্যকর হতে পারে।


এখন চলো, দুই ধরনের মানুষের কথায় ফিরে যাই:

১. যে ব্যক্তি সফল হয়:


সে নিজের উপর বিশ্বাস রাখে।

তার লক্ষ্য ও সফলতায় সে নিশ্চিন্ত থাকে।

👉 মাঝেমধ্যে ব্যর্থতা বা ধাক্কা এলেও

সে থেমে যায় না।

সে জানে— “আমি পৌঁছাবোই!”

সে হয়তো মাঝপথে নিজের লক্ষ্য বা পদ্ধতি বদলায়,

কিন্তু ভিতরে গভীরে একটা শক্ত বিশ্বাস কাজ করে—

যে ওর পৌঁছানো নিশ্চিত।


সে “আমি সফল হব কি না?” এমন করে

বারবার প্রার্থনা করে না।

সে জানে, বিশ্বাস করে

আর ঠিক এই বিশ্বাস চালু করে দেয়

মনোজগতের সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তিগুলো।

২. যে ব্যর্থ হয়:


সে সবসময় ভাবে—

👉 “আমার কপালে নেই। আমার কিছু হবে না।”

সে এইভাবে নিজের জন্য নিজেই অনিবার্য পরিণতি তৈরি করে।

আর বিশ্বাসের জোরেই সে ঠিক সেটাই আকর্ষণ করে—


ব্যর্থতা। দুর্ভাগ্য। হেরে যাওয়া।

❖ অতএব, বাস্তবতা কী?


👉 “চান্স” বা “দুর্ভাগ্য” বলে কিছু নেই।

বিশ্ব চলছে নিয়মে—কার্যকারণ, পরিকল্পনা ও আকর্ষণের নিয়মে।


👉 তুমি যদি নিজেকে সঠিকভাবে সেট করো—

যদি নিজের চিন্তাগুলোকে সুস্পষ্ট, আত্মবিশ্বাসী ও ইতিবাচক রাখো—

👉 তাহলে তুমি নিজেই নিজেকে

সেই আকর্ষণ-প্রবাহের মধ্যে নিয়ে আসবে

যেখানে সবকিছু একে একে তোমার দিকে ধাবিত হতে থাকবে।

নিজের জন্য সেই স্রোতের ভিতর ঢুকে পড়ো—

তোমার বিশ্বাসের কম্পনে জাগাও নতুন ভবিষ্যৎ।


👉 কারণ, ভাগ্য নয়— তোমার নিজের ভাবনার আকর্ষণশক্তি

তোমার পরিণতির পথ তৈরি করে দেয়। 🌱


অধ্যায় ১৬-এর দ্বিতীয়াংশ: “নিয়ম, নয় ‘দুর্ভাগ্য’”

(বাংলা অনুবাদ — আত্মবিশ্বাস-উদ্দীপক, সহজ ও গভীরভাবে বোধগম্য)


একজন মানুষ যদি ঠিক একই দৃঢ়তায় বিশ্বাস করে

যে সে অবশ্যই ব্যর্থ হবে,

তবে সে নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হবেই।


কেন?

এটা কোনও অলৌকিক ব্যাপার নয়।


🔹 সে যা ভাবে,

🔹 যা বলে,

🔹 এবং যা করে—

সবকিছুতেই ব্যর্থতার রঙ লেগে থাকে।


মানুষও টের পায় তার এই “ব্যর্থতার বাতাস”,

এবং আর তার উপর ভরসা রাখতে চায় না।


❖ অথচ সে ভাবে—

“দেখো! আবারো দুর্ভাগ্য আমার পেছনে লেগে আছে।”

কিন্তু সে বোঝে না—

👉 এই “দুর্ভাগ্য” তার নিজের ভাবনারই প্রতিফলন।


সে নিজেকেই বারবার বলছে—

“আমি পারব না”, “আমি ব্যর্থ হব”,

আর সেই “অটো-সাজেশন” বা নিজেকে দেওয়া নিঃশব্দ আদেশ

তার মনের ভিতরে গেঁথে যাচ্ছে—

🔻 ফলে তার চিন্তা, কাজ, অনুভূতি—সব

একটাই রঙে রাঙা হয়ে যাচ্ছে:

ব্যর্থতা।


এমন অবস্থায়

মস্তিষ্কের সেই অংশ বন্ধ হয়ে যায়

যেখানে সাধারণত উজ্জ্বল পরিকল্পনা, নতুন আইডিয়া ও সাফল্যের পথ তৈরি হয়।

এই অংশ তখন আর কাজ করতে পারে না।


❖ কারণ কী?


👉 সেই মানসিক পরিবেশ—

হতাশা, ভয় ও আত্মবিশ্বাসহীনতা—

এগুলো কোনও উজ্জ্বল চিন্তার জন্ম দিতে পারে না।


✦ আমরা কেবল তখনই দারুণ ধারণা পাই

যখন আমরা উৎসাহী, আত্মবিশ্বাসে ভরা, এবং

ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।

মানুষ মানুষের মন টের পায়


🔹 কিছু মানুষ আছে যাদের কাছাকাছি গেলেই বোঝা যায়—

এই মানুষটা ব্যর্থতার ভারে দমে গেছে।


🔹 আবার কিছু মানুষ আছে যাদের সম্বন্ধে লোকজন বলে—

“ওকে দমন করা যাবে না! ও ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে।”


এটাই সেই মানসিক আবহাওয়া (Mental Atmosphere)

যেটা মানুষ অনুভব করে।


📌 অতএব, নিজের মানসিক পরিবেশ পরিষ্কার করো।

নিরাশার ধোঁয়া সরিয়ে ফেলো।

আত্মবিশ্বাসের আলো জ্বালো।


এখন মনে রাখো— “দুর্ভাগ্য” বলে কিছু নেই।


👉 এই মহাবিশ্ব চলে নিয়মে।

চাকায় চাকায় ঘোরে কার্য্য-কারণের সমীকরণ।

পরিকল্পনা আর উদ্দেশ্য, কারণ আর ফলাফল—

সবকিছুর ভিত্তিই সেখানেই।


🔹 তুমি একটা সরল ঘটনাও দেখাতে পারবে না

যেটা সম্পূর্ণরূপে আকস্মিক।


চেষ্টা করে দেখো—

বিশ্লেষণ করতে করতে শেষে তুমি পৌঁছাবে

👉 নিয়মের ভিত্তিতে তৈরি একটা প্রক্রিয়ার দিকে।


👉 জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়।

তুমি বিশ্বাস করো বা না করো,

তুমি জানো বা না জানো—

নিয়ম ঠিকই চলছে।


তুমি হয়তো এই নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ,

বা হয়তো তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে এর বিরুদ্ধে চলছো—

ফলে নিজেই নিজের জন্য বিপত্তি ডেকে আনছো।


❖ আবার তুমি চাইলে এই নিয়মের স্রোতে মিশেও যেতে পারো,

নিজেকে এই আকর্ষণশক্তির প্রবাহে

সহজে ভাসিয়ে দিতে পারো।


👉 কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো:


তুমি এই নিয়মের বাইরে যেতে পারবে না।

তা সে তুমি যতই তা অস্বীকার করো না কেন।


তুমি চাইলে এর বিরুদ্ধে গিয়েই

শিক্ষা নিতে পারো তিক্তভাবে।


❖ কিন্তু একটা সময় আসবে

যখন তুমি বুঝবে—

নিয়মকে সম্মান করাই সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তা।


📌 সুতরাং, সিদ্ধান্ত তোমার:


🔹 তুমি কি নিজের ভয়, দুর্ভাবনা আর “আমি পারি না” দিয়ে

নিজের জীবনে ব্যর্থতা আকর্ষণ করবে?


🔹 নাকি তুমি আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা আর আশায় ভর করে

নিয়মের স্রোতে উঠবে—

আর জীবনের দিকে এগিয়ে যাবে, সোজা পথ ধরে?


🌀 নিয়ম আছেই—

তুমি কীভাবে এর সঙ্গে চলবে, সেটাই তোমার চাবিকাঠি।


অধ্যায় ১৬-এর শেষাংশ: “নিয়মের সঙ্গে একাত্ম হও”

(বাংলা অনুবাদ — আত্মবিশ্বাস-উদ্দীপক, সহজ ও গভীরভাবে বোধগম্য)


“আকর্ষণশক্তির নিয়ম”—যা আমরা চিন্তার আকর্ষণশক্তি বলি—

এটি আসলে মহান নিয়মের একটি প্রকাশমাত্র।


❖ আবারও বলি,

তোমার চিন্তারা আসল জিনিস—

জীবন্ত শক্তি।


🔹 তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে,

🔹 নিজেদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ চিন্তার সাথে যুক্ত হয়,

🔹 বিপরীতমুখী চিন্তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়,

🔹 নিজের জাত চিনে ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছে যায়,

🔹 আর এমন চিন্তা থেকে দূরে সরে যায়

যা তার সঙ্গে সুর মেলাতে পারে না।


তোমার মনও ঠিক এভাবেই

🔸 অন্য মানুষের পাঠানো চিন্তা আকর্ষণ করে—

সে তারা সচেতনভাবে পাঠাক বা না পাঠাক।


📌 তবে মন কেবলমাত্র সেইসব চিন্তা-তরঙ্গই আকর্ষণ করে,

যা তার নিজের সাথে মিল খায়।


🌀 “যেমন মন, তেমন আকর্ষণ”—

আর বিপরীত মন মানেই বিযুক্তি—

এটাই চিন্তার জগতে সবচেয়ে বড় নিয়ম।

🔔 যদি তুমি নিজের মনকে

সাহস, আত্মবিশ্বাস, শক্তি ও সফলতার মূলসুরে বাঁধো,

তবে তোমার চেতনা ঠিক সেই ধরণের চিন্তা,

মানুষ, এবং পরিস্থিতিকে নিজের দিকে আকর্ষণ করবে,

যা সেই সুরের সাথে মানানসই।


তোমার ভিতরের প্রধান ভাব—

তুমি যেভাবে নিজের জীবনকে ভাবো,

তাই নির্ধারণ করবে

তোমার জীবনে কাকে, কীকে ও কেমন পরিস্থিতিকে

আনতে চলেছো।


👉 আজ তুমি যে চিন্তার ঢেউ সৃষ্টি করছো,

তা ভবিষ্যতে টেনে আনবে

তেমনি স্বরবৃত্তির মানুষ ও বাস্তবতাকে।


এমনকি অন্যদের সঙ্গেও

তোমার চিন্তার মিল হলে,

তোমরা একে অপরের দিকে আকৃষ্ট হবে—

এবং খুব সম্ভব এক সময় একত্রিত হবে

একটি সাধারণ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে।


🧭 যদি মাঝপথে কেউ নিজের চিন্তার ধারা না বদলায়,

তবে এই সংযুক্তি হবেই।

🔑 তাই করণীয় কী?

নিয়মের বিরুদ্ধে নয়,

👉 নিয়মের সঙ্গে সুর মিলাও।

তাকে নিজের একাংশ করে তোলো।

তার প্রবাহে প্রবেশ করো।

তোমার অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বজায় রাখো।


🗝️ তোমার চিন্তাকে বাঁধো এই সুরে:

সাহস—আত্মবিশ্বাস—সাফল্য।


এই রকম ভাবনার সঙ্গে যুক্ত থেকো,

যেগুলো প্রতি মুহূর্তে

শত শত মানুষ ছড়িয়ে দিচ্ছে জগতে।

❖ ভালো জিনিসগুলো খুঁজে নাও চিন্তার জগতে—

সেই ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ রয়েছে—

🔹 তাই কখনও কমে সন্তুষ্ট থেকো না।


🤝 ভালো চিন্তাশীলদের সঙ্গে মনের বন্ধনে আবদ্ধ হও।

নিজেকে রাখো ঠিক স্বর ও কম্পনের ভিতরে।


তুমি কি এখনো

🔹 জীবনের নিয়মের অজানায় ভাসছো?

🔹 অভ্যন্তরীণ দিশেহারার মাঝে

নিজেকে ঠেলে দিচ্ছো শুধু?


তবে থামো।

এখনই নিয়মের সঙ্গে তাল মিলাও।

তবেই জীবন তোমার হয়ে উঠবে

একটি গভীরতর সংগীত—

একটি চমৎকার সুরের প্রবাহ,

যার ভিতরে তুমি নিজেকে আবিষ্কার করবে

নতুনভাবে, সার্থকভাবে।

🌟 কারণ তুমি একাই নও—নিয়ম তোমার সঙ্গে।




Translated by Suman Das 

ক্ষমাপ্রার্থী কিছু লাইনের আক্ষরিক অনুবাদের জন্য।।